মো. কামরুজ্জামান: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া ২১: আয়াত ১০৭) এ কথার ভাবার্থ হচ্ছে, বিশ্বের মানুষের জন্য কল্যাণকর রূপে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে পাঠানো হয়েছে। মহানবি (সা.)-এর রহমতসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপন্থার কারণে অশান্ত আরবসমাজে শান্তি ফিরে আসে। নিম্নে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
বিশ্বভ্রাতৃত্ব: আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি।’ (সূরা হুজরাত ৪৯: আয়াত ১৩)
এই একজন পুরুষ হচ্ছেন আদম (আ.) এবং এই একজন নারী হচ্ছেন হাওয়া (আ.)। পৃথিবীর সব মানুষের আদি পিতা হচ্ছেন আদম (আ.) এবং আদি মাতা হচ্ছেন হজরত হাওয়া (আ.)। বিশ্বের সব মানুষই এই আদি পিতামাতার সন্তান। এ কারণে বিশ্বের সব মানুষ ভাই ভাই। আর এটাই বিশ্বভ্রাতৃত্ব।
শান্তি-শৃঙ্খলা: এই পৃথিবীতে ভালোভাবে জীবন যাপন করার জন্য, উন্নতির জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি-শৃঙ্খলা থাকা অপরিহার্য। তাই ইসলাম ধর্মে পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, বজায় রাখার ওপর অতীব গুরুত্ব প্রদান করা হয়। মানুষের ওপর অত্যাচার না চালানো, পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ না করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা না করা, আপস নিষ্পত্তি করে দেওয়া ইত্যাদি হচ্ছে পৃথিবীর মানুষের জন্য শান্তি-শৃঙ্খলামূলক কল্যাণকর কাজ। যেমন-
১. বিদ্রোহ, অত্যাচার ও ফিতনা-ফ্যাসাদ করা : অন্যায় বিদ্রোহ, ফিতনা-ফ্যাসাদ ও অত্যাচার মানুষের শান্তি-শৃঙ্খলাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে, মানুষের শান্তিময় জীবনকে বিষময় করে তোলে। মানুষকে এগুলো না করার জোরালো নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহের আচরণ করে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সূরা শুরা ৪২: আয়াত ৪২)
২. জানমালের নিরাপত্তা: মানুষের জীবন ও মালের নিরাপত্তার ব্যাপারে ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানুষের জীবনের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা কোরো না, যা আল্লাহ্ নিষিদ্ধ করেছেন, যে ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয় আমি তার উত্তরাধিকারকে অধিকার দিয়েছি (সে ইচ্ছা করলে রক্তের বিনিময় দাবি করতে পারে), তবে সে যেন হত্যার (প্রতিশোধ নেওয়ার) ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে।’ (সূরা বনি ইসরাঈল ১৭: আয়াত ৩৩) আর সম্পদের ব্যাপারে আল্লাহ্ বলেন, ‘তোমরা একে অন্যের ধন-সম্পদ (মাল) অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ কোরো না।’ (সূরা বাকারা ২: আয়াত ১৮৮)
৩. ন্যায়বিচার করা: ন্যায়বিচার না থাকলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়বিচারের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকো।’ (সূরা নিসা ৪: আয়াত ১৩৫)
৪. ঝগড়া না করা: ঝগড়া করলে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত হয়, মারামারি, সংঘর্ষ হওয়ার উপক্রম হয়। হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, ঝগড়াটে হওয়াই তোমার পাপিষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট। (তিরমিজি শরীফ) অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, সেই লোক আল্লাহ্র কাছে অত্যধিক ঘৃণিত যে অত্যধিক ঝগড়াকারী। (বুখারি শরীফ)
৫. আপস নিষ্পত্তি করা: আপস-নিষ্পত্তি দ্বারা পরিবারে, সমাজে, এমনকি এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের বিবাদ দূর হয় এবং শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘যে ক্ষমা করে দেয় ও আপস-নিষ্পত্তি করে তার পুরস্কার আল্লাহ্র নিকট রয়েছে।’ (সূরা শুরা ৪২: আয়াত ৪০)
৬. পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা: পরিবারে শান্তি-শৃঙ্খলা থাকলে সন্তানদের উন্নতির জন্য তা সহায়ক হয়, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা ও উন্নতিতে ব্যাপক অবদান রাখে। পরিবারের কর্তা হচ্ছেন বাবা এবং কর্ত্রী হচ্ছেন মা। পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য সন্তানদের মা-বাবাকে (বৈধ কাজে) মেনে চলা অপরিহার্য। এজন্য সন্তানদের মা-বাবার প্রতি প্রয়োজনীয় কর্তব্য পালন করতে হয়। আবার মা-বাবাকেও তেমনি সন্তানদের প্রতি প্রয়োজনীয় কর্তব্য পালন করতে হয়।
৭. মা-বাবার প্রতি সন্তানের কর্তব্য: সন্তানদের মা-বাবার প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে আল্লাহ্ বলেন, ‘তোমরা (তোমাদের) মাা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, তাদের একজন কিংবা উভয়ই যদি তোমাদের জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদের (সঙ্গে) বিরক্তিসূচক কিছু বলো না, তাদের ধমক দিয়ো না এবং তাদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলো।’ (সূরা বনি ইসরাঈল ১৭: আয়াত ২৩)
৮. সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য: পিতামাতার সন্তানদের প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ও নিজেদের পরিবারকে আগুন (দোজখ) থেকে বাঁচাও।’ (সূরা তাহরিম ৬৬: আয়াত ৬)
৯. নারীর অধিকার: ইসলাম নারীদের শান্তিতে থাকার জন্য ন্যায্য অধিকার দিয়েছে। ইসলামে নারীদের পৈতৃক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার, স্বাধীনভাবে অর্থ উপার্জন ও নিজের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘পুরুষরা যা উপার্জন করে তা তাদের প্রাপ্য অংশ (হবে), আবার নারীরা যা কিছু উপার্জন করে তা তাদেরই প্রাপ্য অংশ (হবে)।’ (সূরা নিসা ৪: আয়াত ৩২) অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর ন্যায়সংগত অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর।’ (সূরা বাকারা ২: আয়াত ২২৮)
১০. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি: যেহেতু হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ তথা কল্যাণকররূপে প্রেরণ করা হয়েছে, তাই সব সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার বিষয়টি ইসলামে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়। আল্লাহ্ বলেন, ‘তারা (অমুসলমানরা) আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে যাদের ডাকে তাদের তোমরা গালি দিও না। তা না হলে তারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহ্কেও গালি দিয়ে বসতে পারে।’ (সূরা আনআম ৬: আয়াত ১০৮)