কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা: কুড়িগ্রামে ছোট বড় অনেক নদী রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমার নদবেষ্টিত এ জেলায় নদীগুলোতে প্রায় সাড়ে ৪ শতাধিক চর রয়েছে। দুধকুমার নদ ও শাখা নদ ফুলকুমার নদের কোল ঘেঁষে একটি দুর্গম চরাঞ্চল ফান্দেরচর। যেখানে নেই শিক্ষার কোনো বালাই। শিক্ষার হার অনেক কম। বন্যা, খরা, নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে চলতে হয় চরের মানুষকে। সড়ক পথ না থাকায় প্রতিনিয়ত নানান বিড়ম্বনায় পড়তে হয় এ চরের বাসিন্দাদের। এখানকার একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে নৌকা। এ চরে এখন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন সহিদুল-শাপলা নামে এক দম্পতির তৈরি করা পাঠশালা। চরটির অবস্থান জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ ইউনিয়নের চর পূর্ব দামালগ্রামে। প্রায় ১০ বছর আগে জেগে ওঠা এই চরে বসতি স্থাপন করে অন্তত দুই শতাধিক পরিবার। তাদের অধিকাংশই নদী ভাঙনের শিকার হয়ে বিভিন্ন চর থেকে উঠে আসা। আধুনিক সভ্যতার এ যুগে যাতায়াত, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত চরবাসী। কৃষি, গবাদি পশুপালন ও নদীতে মাছ ধরাই তাদের আয়ের উৎস। অন্যদিকে নদীভাঙনে বাপ-দাদার ভিটামাটি হারিয়ে এক চর থেকে আরেক চরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হচ্ছে তাদের। এ অবস্থায় শিক্ষা তো দূরের কথা, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে চলতে হয় প্রতিনিয়ত। এ চরে দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় অনেক শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেকেই দিনমজুর, মাছ ধরা, গবাদি পশু দেখভাল করাসহ বিভিন্ন শিশু শ্রম করে যাচ্ছিল। এদের অনেকেই জেলার বাইরে গিয়ে শ্রম বিক্রি করেও সংসারে অর্থের জোগান দেয়। অভিভাবকদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাদের সন্তানদের চরের বাইরে রেখে পড়াশোনা করা মোটেও সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাছাড়া এসব চরের বাসিন্দার অনেকের নেই কোনো সামর্থ্য। ফলে সন্তানদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নই থেকে যায়। মেয়ে শিশুকে দ্রুত বাল্যবিয়ের শিকার হতে হয়। নদ-নদী বেষ্টিত এ চরের চারদিকে তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এ চরের ৯০ ভাগ মানুষই নিরক্ষর। এখানে বাল্যবিয়ের হার অনেক বেশি। এ রকম একটি চরের শিক্ষিত দম্পতি সহিদুল ইসলাম ও শাপলা আক্তার স্বপ্না। সহিদুল টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সসহ মাস্টার্স শেষ করেন। আর স্ত্রী শাপলা আক্তার স্বপ্না কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সে অধ্যয়নরত। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ঝরে পড়া এই শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়াতে এগিয়ে এসেছেন এ দম্পতি। ২০২২ সালের ২২ আগস্ট চরের পরিত্যক্ত একটি মক্তব ঘরে তিন-চারজনকে নিয়ে শুরু হয় তার এ পাঠশালার কার্যক্রম। নাম দেওয়া হয় ফান্দেরচর বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র। যতেœ ও নজরদারিতে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে শিক্ষার্থী। পরে এর নাম রাখা হয় ‘শাপলার পাঠশালা’ নামে। পাঠশালাটিতে বর্তমানে নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা শতাধিক। পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে। ৪০ ফুট লম্বা মাত্র দো-চালা একটি টিনের ঘরে রয়েছে শ্রেণিকক্ষ। তবে আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। ঘরটিতে দুটি দরজা থাকলেও নেই জানালা। নদীভাঙনের শিকার পাঠশালাটি গত দুই মাস আগে পশ্চিম ফান্দেরচর থেকে পূর্ব ফান্দেরচর এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। মেঝেতে পলিথিন, মাদুর ও ছেঁড়াফাটা জামাকাপড় ও ঝুটম্যাট বিছিয়ে চলে শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রম। তিন সারি করে বসে ছাত্রছাত্রীরা পাঠদানে অংশ নেয়। পালাক্রমে শ্রেণি শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সহিদুল ও শাপলা। তাদের এমন উদ্যোগে খুশি চরের বাসিন্দারা।
- October 16, 2023
0
37
Less than a minute
You can share this post!
editor