বিলিয়ন ডলার হেইস্ট (শতকোটি ডলারের ডাকাতি)

বিলিয়ন ডলার হেইস্ট (শতকোটি ডলারের ডাকাতি)

(বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ডাকাতি নিয়ে নির্মিত ‘বিলিয়ন ডলার হেইস্ট’ ডকুমেন্টারি অবলম্বনে লিখিত)
পার্ট-৫
বাংলাদেশী সময় থেকে দশ পিছিয়ে থাকা নিউইয়র্কে সবেমাত্র কর্মঘন্টা শুরু হচ্ছে। ফেডারেল রিজার্ভের কর্মকর্তারা দেখল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩৫ লেনদেনের অনুরোধ এসেছে, যার মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভে থাকা বাংলাদেশের প্রায় পুরো অর্থ লেনদেন করতে অনুরোধ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সাধারণত ৩ লাখ বা ৫ লাখ ডলার লেনদেন করা হয়, কিন্তু এবারে প্রায় ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার লেনদেনের অনুরোধ করা হয়েছে। কর্তব্যরত অপারেটর লেনদেনের অনুরোধগুলো বাতিল করে ফেরত পাঠায়। টাকার অংক অনেক বেশি, এই কারণে কিন্তু লেনদেন বাতিল করা হয়নি বরং লেনদেনের অনুরোধগুলো সঠিক নিয়মে করা হয়নি। হ্যাকাররা সবই ঠিকমত করেছিল কিন্তু ফর্মপূরণে একটু ভুল করে ফেলেছিল।
হ্যাকররা তখন নতুন করে ফর্মপূরণ করে পুনরায় লেনদেন অনুরোধ পাঠায়, তারা ৩৪টি অনুরোধ পুনরায় পাঠায়, একটির কথা ভুলে যায়। তারা তারপর লেনদেনগুলো অনুমোদন হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। হ্যাকাররা যখন ৩৪টি লেনদেন অনুরোধ আবার পাঠায়, তার মধ্যে ৪টি অনুমোদন হয়। ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার অর্থ ফিলিপাইনের অ্যাকাউন্টগুলোতে ট্রান্সফার হয়, যে অ্যাকাউন্টগুলো হ্যাকারদের লোকেরা প্রায় ছয় মাস আগে খুলেছিল।
হ্যাকাররা জানত, যখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীরা সুইফট কম্পিউটারে কাজ করতে বসবে, লেনদেনের বিষয়টি সাথে সাথেই জেনে যাবে। তাই হ্যাকাররা তাদের লেনদেনের সকল তথ্য মুছে দেয়। কিন্তু সকল ডিজিটাল লেনদেনেরই হার্ডকপি রাখা হয়, হ্যাকাররা সেটা জানত। যেকোনো সুইফট লেনদেন হওয়ার সাথে সাথেই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রিন্টার থেকে সেই লেনদেনের প্রিন্ট কপি বেরোয়। সুতরাং ডাকাতি চলাকালে সেই প্রিন্টার চালু থাকা চলবে না। হ্যাকাররা প্রিন্টার হ্যাক করে সব লেনদেনের পরিমাণের ঘরে শুন্য বসিয়ে দেয়, যাতে কোনো প্রিন্ট না বেরোয়।
এদিকে বাকি ৩০টি লেনদেন অনুরোধ তখনো নিস্পত্তি হয়নি। হ্যাকাররা অপেক্ষা করতে থাকে এবং লেনদেন সম্পন্ন না হওয়ায় অবশেষে বাংলাদেশী সময় ৩টা ৫৯ মিনিটে তারা লগআউট করে চলে যায়। তারা হয়ত ভেবেছিল, নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় কর্মঘন্টা শেষ হয়ে যাওয়ায় তাদের লেনদেন অনুরোধগুলো নিস্পত্তি হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ফেডারেল রিজার্ভ তাদের লেনদেনগুলো আটকে দিয়েছিল কারণ তাদের অ্যাকাউন্টগুলো ফিলিপাইনের যে ব্যাংকে ছিল, সেই ব্যাংকের শাখাটি ‘জুপিটার’ রোডে অবস্থিত ছিল।
আর এখানেই গল্প নাটকীয়তায় মোড় নেয়। দুই বছর পূর্বে এক গ্রিক জাহাজ মালিক দিমিত্রি ক্যামবিস আটটি তেলের ট্যাংকার কিনতে যাচ্ছিলেন। আমেরিকানরা জানতে পারে, দিমিত্রির ট্যাংকার কেনার টাকা দিচ্ছে ইরান, আর ইরানের উপর আমেরিকান অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর আছে। ফলে দিমিত্রির কোম্পানি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার নজরদারি তালিকায় চলে আসে এবং তার কোম্পানীর নাম ছিল ‘জুপিটার সি ওয়েজ’।
হ্যাকারদের ভাগ্য খারাপ, কারণ তারা রিজার্ভ ডাকাতির অর্থ ম্যানিলার রিজাল ব্যাংকের ‘জুপিটার’ শাখায় পাঠাচ্ছিল। ফেডারেল রিজার্ভ থেকে যখন রিজাল ব্যাংকের জুপিটার শাখায় অর্থ পাঠানো হচ্ছিল, সিকিউরিটি সিস্টেম থেকেই লেনদেনগুলো আটকে যায়। ফেডারেল রিজার্ভের কর্মীরা বিষয়টি এটা পুনরায় চেক করেন। তখন তারা দেখতে পান, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার লেনদেনের অনুরোধ করা হয়েছে, এটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তাই তারা লেনদেন আটকে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনরায় বিষয়টি নিশ্চিত করার অনুরোধ জানায়। কিন্তু হ্যাকাররা ইতোমধ্যে লগআউট করে চলে গেছে। তারা যদি আর মাত্র এক ঘন্টা অপেক্ষা করত, তারা সুইফট সিস্টেমের মাধ্যমে জবাব দিতে পারত যে, লেনদেনের অনুরোধে কোনো ভুল নেই। আর তাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ রিজার্ভ ডাকাতি হয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ অর্থ ডাকাতি হয়ে যেতে পারত। তারা ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সরাতে পেরেছিল, কিন্তু সংখ্যাটা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারও হতে পারত।
(চলবে)

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *