করোনার টিকার জন্য নোবেল পেলেন দুই বিজ্ঞানী

করোনার টিকার জন্য নোবেল পেলেন দুই বিজ্ঞানী

বিজ্ঞান ডেস্ক: করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ থাবায় বিপর্যস্ত বিশ্ব। সারা বিশ্বে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছিল। তখন করোনার টিকার এমআরএনএ প্রযুক্তি আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন দুই বিজ্ঞানী। তাঁরাই পেয়েছেন সবচেয়ে গৌরবময় নোবেল পুরস্কার।
২০২৩ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেল পেয়েছেন হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী কাতালিন ক্যারিকো ও মার্কিন বিজ্ঞানী ড্রু ওয়াইজম্যান। করোনা ভাইরাসের কার্যকর টিকা আবিষ্কারে তাঁদের গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, এজন্যই তাঁরা এই পুরস্কার পেলেন। গত সোমবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে সুইডিশ নোবেল কমিটি এই দুই বিজ্ঞানীর নাম ঘোষণা করে। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীরা নোবেল পদকের পাশাপাশি পাবেন একটি সনদপত্র, মোট ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার বা ১১ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
করোনার টিকা তৈরির পদ্ধতি গতানুগতিক টিকার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাধারণ টিকা তৈরি দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া। তাতে কয়েক বছর থেকে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। কিন্তু করোনা মোকাবেলায় দরকার ছিল দ্রুত টিকা আবিষ্কারের।
এজন্য বিজ্ঞানীরা হাঁটেন বিকল্প পথে। তাঁরা করোনার জিনোম বিশ্লেষণ করে আরএনএ ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে সক্ষম হন দ্রুততম সময়ে।
সুইডিস নোবেল কমিটির ফিজিওলজি বা মেডিসিন বিভাগের সেক্রেটারি টমাস পার্লম্যান বলেন, ‘তাঁদের গবেষণা নতুন দিক উন্মোচন করেছে। তাঁরা দেখিয়েছেন কিভাবে আরএনএ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে, এ বিষয়ে আমাদের আগের ধারণাটাই বদলে দিয়েছে। তাঁদের দেখানো পথ করোনার টিকা তৈরি ও বিকাশে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে।
৩০ জানুয়ারি ২০২০, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আন্তর্জাতিকভাবে জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করে। কারণ, চীনের উহান প্রদেশ থেকে পুরো বিশ্বে বেশ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সারস-কোভ-২ (ঝঅজঝ-ঈড়ঠ-২) নামের করোনা ভাইরাস। জরুরি অবস্থা জারি করেও লাভ হলো না। এই ভাইরাস পুরো পৃথিবীতে মহামারি বাধিয়ে দেয়। বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মারা পড়ে করোনার সংক্রমণে। পৃথিবীর মানুষকে বাঁচানোর গুরুদায়িত্ব তখন সব স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাঁধে। ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মোক্ষম উপায় হলো টিকা প্রয়োগ।
বিশ্বের বিজ্ঞানীরা তখন উঠে পড়ে লাগেন করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে। এত দ্রুত টিকা প্রস্তুত করতে পারার একটা প্রধান কারণ এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার। ক্যাতারিন ক্যারেকি ড্রু ওয়াইজম্যান অনেক আগেই দেখিয়েছেন এমআরএনএর নাইট্রোজেনাস ক্ষার পরিবর্তন করে এমআরএনএ কিভাবে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে।’
কোনো জীবাণুকে এর বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তুলতে টিকা প্রয়োগ। আগে সাধারণত টিকা তৈরি করতে দুর্বল কিংবা মৃত ভাইরাস ব্যবহার করা হতো। আক্রান্ত হওয়ার আগেই দুর্বল কিংবা মৃত ভাইরাসকে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো মানুষের শরীরে। ফলে আগে থেকেই মানবদেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রস্তুত থাকতে পারে। পোলিও কিংবা হামের টিকাগুলো এই গতানুগতিক পদ্ধতিতেই তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের টিকা তৈরি করতে অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই এই নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে।
নতুন এই টিকা তৈরি করতে সম্পূর্ণ ভাইরাসটিকে ব্যবহার না করে কোনো অংশ যেমন-প্রোটিন কিংবা ভাইরাসের জিনোমের কোনো অংশ ব্যবহার করা হয়। কিংবা ভাইরাসের জিনোমের কোনো অংশ ক্ষতিকর না এমন কোনো ভাইরাল বাহকের ভেতর প্রবেশ করিয়েও টিকা প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ ভাইরাস, প্রোটিন কিংবা বাহক ব্যবহার করে তৈরি টিকার একটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে-বেশ বড় পরিসরে কোষ কালচার করতে হয়, যার জন্য অনেক সময়ের দরকার হয়। কিন্তু মহামারির সময় অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণে টিকা উৎপাদন করাটা জরুরি হয়ে পড়ে।
আমাদের কোষে প্রোটিন তৈরি হয় বার্তাবাহক আরএনএ (সজঘঅ-সবংংবহমবৎ জঘঅ) থাকা জিনোম সংকেত থেকে। আর এই এমআরএনএ তৈরি হয় ডিএনএ থেকে ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ায়। আশির দশকেই বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে কোনো রকম কোষ কালচার ছাড়াই কিভাবে এমআরএনএ প্রস্তুত করতে হয় সেই পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেন। এই আবিষ্কারই এমআরএনএ ব্যবহার করে টিকা তৈরির দ্বার খুলে দেয়। কিন্তু একটা বড় বাধা রয়ে গেল। গবেষণাগারে বানানো এমআরএনএর স্থিতিশীলতা খুব কম হয়। ফলে এভাবে তৈরি এমআরএনএ কোষের ভেতর প্রবেশ করানোটা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। এজন্য এমআরএনএকে বিশেষ প্রকার লিপিডের তৈরি ক্যাপসুলের ভেতর আবদ্ধ করে নিতে হয়। পাশাপাশি গবেষণাগারে তৈরি এমআরএনএ প্রয়োগে শরীরের ভেতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কিন্তু এসব বাধা থামাতে পারেনি হাঙ্গেরিয়ান প্রাণরসায়নবিদ ক্যাতালিন ক্যারিকোকে। তিনি তখন এমআরএনএকে চিকিৎসা থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করে গবেষণা করছিলেন। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় মার্কিন ইমিউনোলজিস্ট ড্রু ওয়াইজম্যানের। ওয়াইজম্যান ডেনড্রাইটিক কোষ নিয়ে বেশ কৌতূহলী ছিলেন। এই বিশেষ ধরনের কোষগুলো ভ্যাকসিন প্রয়োগে সৃষ্ট প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে সক্রিয়করণে ভূমিকা রাখে। পরে এই দুই সহকর্মী এক জোট হয়ে গবেষণা শুরু করলেন, বিভিন্ন ধরনের আরএনএ কী করে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে সেটা বোঝাতে।
ক্যারিকো ও ওয়াইজম্যান খেয়াল করলেন, ডেনড্রাইটিক কোষগুলো গবেষণাগারে প্রস্তুত এমআরএনএকে অ্যান্টিজেন হিসেবে শনাক্ত করে। সেই সঙ্গে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এমআরএনএর বিরুদ্ধে সক্রিয় করতে নানারকম প্রদাহ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক তৈরি করতে থাকে। কিন্তু সরাসরি স্তন্যপায়ী কোষ থেকে নেওয়া এমআরএনএর ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। আরএনএতে এডিনিন, সাইটোসিন, ইউরাসিল ও গুয়ানিন নামের চার রকমের বেস থাকে। সরাসরি স্তন্যপায়ী কোষ থেকে নেওয়া এমআরএনএর বেসগুলোতে বেশ দ্রুত রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কিন্তু গবেষণাগারে তৈরি এমআরএনএর ক্ষেত্রে সে রকমটা হয় না। আর সে কারণেই স্তন্যপায়ী কোষ থেকে নেওয়া এমআরএনএ সে রকম কোনো সাড়া তৈরি করে না। পরে ২০০৮ এবং ২০১০ সালে, ক্যারিকো এবং ওয়াইজম্যান দেখান, বেস পরিবর্তন করে এমআরএনএ অপরিবর্তিত এমআরএনএর তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে প্রোটিন তৈরি করে। আর এভাবেই, এমআরএনএর বেস পরিবর্তন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টির পরিমাণ কমিয়ে আনে এবং প্রেটিন উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। ফলে এমআরএনএকে থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করায় আর কোনো বাধা রইল না। আর এরই ধারাবাহিকতায়, সম্ভব হয়েছে এমআরএনএ ভ্যাকসিন আবিষ্কার। এ ধরনের ভ্যাকসিন উৎপাদন করার জন্য অনেক বেশি সময় নিয়ে কোষ কালচার করার দরকার পড়ে না। কেননা ভ্যাকসিন তৈরি করার জন্য দরকারি এমআরএনএ গবেষণাগারেই প্রস্তুত সম্ভব হয়। ফলে অল্প সময়ে অনেক বেশি পরিমাণে টিকা উৎপাদনও সম্ভব হয়।
কাতালিন ক্যারিকো ও ড্রু ওয়াইজম্যান বেশ আগে থেকেই আরএনএ ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁদের সেই গবেষণা ফলপ্রসূ হলো করোনা ভ্যাকসিন তৈরির সময়। এ কারণেই তাঁদের ঝুলিতে উঠল নোবেলের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *