বিশ্বজিৎ ঘোষ: কবি হিসেবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) সমধিক পরিচিত। বাঙালির কাছে তিনি কখনো কবিগুরু, কখনো বা বিশ্বকবি। শুধু কবি হিসেবেই নয়, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, ছোটগাল্পিক, প্রাবন্ধিক, গীতিকার হিসেবেও তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত। চিত্রশিল্পী হিসেবেও তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
সাহিত্যিক, গীতিকার বা চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ নয়, আজ আমরা দেখব অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে-কর্মযোগী রবীন্দ্রনাথকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রাম-সংগঠনের অনন্য এক চিন্তক। শুধু চিন্তা নয়, বাস্তবক্ষেত্রে সে চিন্তাকে কার্যকর করার জন্য তাঁর কর্মযোগী সত্তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হয়। জমিদারি দেখভালের জন্য পিতার নির্দেশে ১৮৯০-এর দশকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলায় আসেন।
শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসরকে কেন্দ্র করে শুরু হয় তাঁর গ্রাম উন্নয়নের কাজ। শিলাইদহে-শাহজাদপুরে সমবায়ের মাধ্যমে চাষাবাদ করার জন্য তিনি কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। উন্নত জাতের বীজ বপন, জলসেচের ব্যবস্থা, জমির আইল তুলে দেওয়া-এসব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের পরামর্শ দিতেন। চাষাবাদের জন্য কৃষকরা যাতে ঋণ নিয়ে কাজে নিয়োজিত হতে পারেন, এ লক্ষ্যে ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন।
এই ব্যাংক থেকে কৃষকদের বিনা সুদে তিনি ঋণ দিতেন। কৃষকরা যাতে সাক্ষরতা লাভ করতে পারেন, সেজন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারি এলাকায় একাধিক নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। কৃষক-বধূরাও এসব নৈশ বিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পেতেন।
শাহজাদপুরে বাসকালে রবীন্দ্রনাথ সমবায় প্রথার মাধ্যমে জমি চাষ এবং দুগ্ধ উৎপাদনে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। কৃষকদের অনুরোধে তিনি ১ হাজার ২৭২ একর জমি লাখেরাজ ঘোষণা করেন।
এই জমিতে কোনো চাষাবাদ হতো না। গরু স্বাধীনভাবে এখানে বিচরণ করত-এ জমি ছিল গরুর বাসস্থান বা বাথানভূমি। দুগ্ধ উৎপাদন এবং তা বিপণনে সমবায় প্রথার ব্যবস্থা করেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত এই বাথানভূমি এখনো বর্তমান আছে।
পতিসরের কালীগ্রামে গ্রাম সংগঠনের অনেক কাজ করেন রবীন্দ্রনাথ। এখানে অনেক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। শিলাইদহের মতো কালীগ্রামেও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কৃষি ব্যাংক। উত্তরকালে শ্রীনিকেতনকে কেন্দ্র করে গ্রাম উন্নয়নের অনেক কাজে জড়িত হন রবীন্দ্রনাথ। বাংলার কৃষি এবং কৃষকদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন তিনি। মাটির কাছাকাছি কৃষকদের কাছে যেতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কবিতায় এ কথাই উচ্চারণ করেছেন তিনি।
আমার কবিতা গেলেও বিচিত্র পথে
হয়নি তা সর্বত্রগামী-
কৃষকের জীবনের শরিক যে জন
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে-কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিবেশবিজ্ঞানী। মানববান্ধব উন্নয়নের কথা বলেছেন তিনি। পরিবেশের উন্নয়নের জন্য তিনি বৃক্ষরোপণের কথা বলেছেন, বৃক্ষবিষয়ক কবিতা লিখেছেন, প্রকৃতির প্রতিশোধ নিয়ে লিখেছেন নাটক। প্রতিবছর ১ শ্রাবণ গান গেয়ে গাছ রোপণের উৎসব পালন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, মরুবিজয়ের জন্য গ্রহণ করেছেন নানা উদ্যোগ।
একজন শিক্ষা দার্শনিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। প্রকৃতির সান্নিধ্যে মুক্ত পরিবেশে শিক্ষার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের বেশির ভাগ অর্থই রবীন্দ্রনাথ ব্যয় করেছেন শিক্ষা এবং গ্রাম সংগঠনের কাজে, কৃষি ব্যাংকের উন্নয়নের জন্য। শিক্ষাকে এখন এ দেশে পণ্য বানিয়ে ফেলা হয়েছে। শিক্ষার এই পণ্যায়নের ঘোর বিরোধী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শিক্ষাকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন প্রযুক্তি হিসেবে। শিক্ষা-প্রযুক্তি শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিস্বার্থলোভী না করে গড়ে তোলে মানবিক মানুষে। একটি সুষ্ঠু মানবিক এবং গণতান্ত্রিক মানুষ সৃষ্টির জন্য রবীন্দ্রনাথ এ দেশের শিক্ষাকে পুনর্গঠন করতে চেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বশান্তির অতন্দ্র সৈনিক। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-সব সময় রবীন্দ্রনাথ শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, উচ্চারণ করেছেন বিশ্বশান্তির পক্ষে অমোঘ বাণী। বিশ শতকের বিশের দশকে হিটলার-মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। চীনে জাপানি আক্রমণের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়। স্পেনে পপুলার ফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে, মোলার সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালনকারী এই রবীন্দ্রনাথকে জানা এখন খুব দরকার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কর্মযোগী মানুষ। তাঁর এই কর্মযোগী সত্তা সম্পর্কে তেমন আলোচনা দেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথকে পূর্ণাঙ্গরূপে জানতে হলে তাঁর এই কর্মযোগী সত্তাকে জানতে হবে। তাঁর এই কর্মযোগী সত্তা জানাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।