মাসুদুজ্জামান: ইউরোপীয় সাহিত্যের দুটি সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’র মহান লেখক হোমার। গ্রিক সভ্যতার মূল্যবোধগুলো বই দুটিতে প্রতিফলিত হয়েছে। অসংখ্য পৌরাণিক কাহিনি, লোক-উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করে হোমার বীরত্ব, ভাগ্য, সম্মান, আনুগত্য ও ন্যায়বিচারের মতো বিষয়গুলোকে উপজীব্য করেছেন। মহাকাব্য দুটির শৈল্পিক মান এতই উঁচু যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্রন্থ দুটি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়ে আসছে।
পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ওপর সেগুলো গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে, যদিও এই দুটি মহাকাব্যের প্রকৃত লেখক কে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। প্রশ্ন আছে হোমারই কি আসলে সেই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত চারণ কবি, যিনি ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ রচনা করেছিলেন, নাকি যাঁরা কবিতাগুলো গেয়ে শোনাতেন, তিনি ছিলেন তাঁদের প্রতিনিধি? রচনা দুটির উৎকর্ষ নিয়ে তেমন প্রশ্ন নেই। পাশ্চাত্যের সর্বকালের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী রচনা নিঃসন্দেহে ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’।
হোমারের জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। তিনি সম্ভবত একজন আইওনিয়ান গ্রিক ছিলেন। আনুমানিক ৮ম খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এশিয়া মাইনর (আধুনিক তুরস্ক) উপকূলে অথবা সংলগ্ন দ্বীপগুলোর কোনো একটিতে বসবাস করতেন। কিংবদন্তি অনুসারে তিনি অন্ধ ছিলেন এবং নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে চারণ কবি হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মনে করা হয়, তিনি যে নিরক্ষর ছিলেন, সেই বিষয়টিকে আড়াল করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁকে অন্ধ বলা হয়েছে অথবা এও হতে পারে, জীবনের শেষ দিকে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
বাইজেন্টাইনের বেশ কিছু পণ্ডিত তাঁর প্রারম্ভিক জীবন নিয়ে ৬টি জীবনী লিখেছেন, কিন্তু সেই জীবনীগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় না। হোমারের অস্তিত্ব নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। কেউ কেউ এমনও বলেছে, ‘ওডিসি’র লেখক জনৈক সিসিলীয় তরুণী। ‘কবি হোমার’ শুধু একটি ধারণামাত্র। যা হোক, ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ দুটি মহাকাব্যের রচয়িতা হিসেবে তবু হোমারের অস্তিত্ব রয়ে গেছে।
হোমারের উভয় মহাকাব্যের বিষয়বস্তু ট্রোজান যুদ্ধ আর সেই যুদ্ধের বীরদের গল্প। কিংবদন্তি অনুসারে, এটি ছিল এশিয়া মাইনরের উপকূলে অবস্থিত ট্রয় আর গ্রিসের মানুষের মধ্যকার যুদ্ধ, যদিও গ্রিকরা যুদ্ধটিকে প্রকৃত ঐতিহাসিক ঘটনা বলে বিশ্বাস করে, কিন্তু বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পক্ষে প্রত্তনত্ত্বিক প্রমাণ তেমন পাওয়া যায়নি। হোমারের অস্তিত্বের কয়েক শতাব্দী আগে যুদ্ধটি যদি সত্যি সংঘটিত হতো, তাহলে ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণসহ সেই যুদ্ধের কথাও অন্যদের বিবরণ থেকে জানা যেত। মিলত প্রত্তনত্ত্বিক নিদর্শন। এমনকি হোমারের যুদ্ধের বিবরণও আরো অনেক বেশি লোমহর্ষক, ভয়ংকর হতো। এর পরও ট্রোজান যুদ্ধটি ঐতিহাসিক ঘটনা না হলেও এই যুদ্ধের সূত্রে ট্রোজান ও গ্রিক সংস্কৃতির মধ্যে যে দ্ব›দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকত, সেটি কেউ অস্বীকার করেনি, বাস্তব বলেই মনে করেছে।
হোমার সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই বলে প্রত্তনত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, শিল্প এবং তুলনামূলক সাহিত্যের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা তাঁকে জানার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন। প্রতিটি শতাব্দীর দর্শন, কবিতা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, উপন্যাস এবং আরো অনেক কিছুতে বিষয়বস্তু ও কাঠামো উভয় দিক থেকেই তাঁর রচিত মহাকাব্যের অসাধারণ সাংস্কৃতিক প্রতিফলন ঘটেছে। ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’র বিষয়-আশয় ও কাঠামোর প্রতিধ্বনি মিলবে পাশ্চাত্যের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যে। কিন্তু ঐতিহাসিক বিবরণ মেলে না।
‘ওডিসি’ ও ‘ইলিয়াড’-এর সূচনা একটি মহান যুদ্ধ ও একজন মহান বীরের মৌখিক লোককাহিনি থেকে, এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। ‘ওডিসি’ ও ‘ইলিয়াড’-এর লোকমুখে প্রচলিত সংস্করণগুলো স্থানীয় চারণ কবিদের দ্বারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রচলিত ছিল। হোমারের মৃত্যুর পর সম্ভবত তা প্যাপিরাসে (কাগজ) লিপিবদ্ধ হয়। এভাবে একবার লেখা হয়ে গেলে সেগুলো একান্তই হোমারের পারিবারিক অথবা ‘হোমারের পুত্রদের’ একক সম্পত্তি হয়ে ওঠে। চারণ কবিদের সংঘবদ্ধ সদস্যরা এই কবিতাগুলো পরিবেশন ও সংরক্ষণ করতেন। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এথেন্সের স্বৈরশাসক পেইসিসট্রাটাস হোমারের কবিতাগুলো সম্পাদনার জন্য একটি সম্পাদনা পরিষদ গঠন করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, যদি রচনা দুটিতে কোনো বিভ্রান্তিকর অথবা অবমাননাকর কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেসব মুছে ফেলা। হোমারের রচনাগুলোর প্রথম মুদ্রিত সংস্করণ ইউরোপে প্রকাশিত হয় এই সেদিন, ১৪৪৮ সালে। প্রকাশনার এই ধারাটি অব্যাহত ছিল সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত। এরপর তাঁর দুটি মহাকাব্য গদ্য-পদ্য উভয় আঙ্গিকে অসংখ্যবার অনূদিত হয়েছে।
‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’র ভাষা সর্বত্র একই রকম নয়। ফলে এই দুটি মহাকাব্যকে কারো একক রচনা বলে মনে হয় না। একদিকে তাঁদের ভাষা পুরোপুরি সরল, ঘটনাগুলোকে সরাসরি বর্ণনা করা হয়েছে। বর্ণনাকারী ঘটনাগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বিশদভাবে সেসব ঘটনার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে গেছেন। কখনো আবার মূল ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়েছেন। তবে গল্পকে সব সময় এমনভাবে বলে গেছেন, যাতে তা স্বাভাবিক ও অনিবার্য মনে হয়। অন্যদিকে চরিত্রগুলোর মধ্যে দৈনন্দিন যোগাযোগ যেখানে ঘটেছে, সেখানকার ভাষায় মহাকাব্যিক গাম্ভীর্য রক্ষিত হয়নি। এই অংশগুলোও আসলে প্রক্ষিপ্ত অংশ অর্থাৎ মুখে মুখে প্রচলিত ভাষা এসব জায়গায় ঢুকে পড়েছে। তবে তাঁদের মহাকাব্যিক অংশগুলো নামপদ ও বিশেষণ পদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষভাবে নির্মিত সূত্রবদ্ধ ভাষা, যেখানে ছয় পর্বের প্রাচীন ছন্দের সূত্রটি অনুসরণ করা হয়েছে। একটি দীর্ঘ সিলেবলের পরে দুটি সংক্ষিপ্ত সিলেবল (অথবা আরেকটি দীর্ঘ সিলেবল) দিয়ে ছন্দটি গঠিত। সম্ভবত ইন্দো-ইউরোপীয় কাব্যিক ভাষা থেকে গ্রিক কবিরা উত্তরাধিকার সূত্রে এই ছন্দটি পেয়েছিলেন। হোমারের বর্ণনার বেশিরভাগ অংশই আসলে পুনরাবৃত্ত শব্দগুচ্ছ আর ছন্দের সমন্বয়ে গঠিত। ছন্দঃস্পন্দটা কোথাও দ্রুত, কোথাও ধীর, কোথাও বা মাঝারি গতির।
পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ‘ইলিয়াড’ ও হোমারের প্রভাব বিস্ময়কর আর অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। নির্মাণ করে দিয়েছে পশ্চিমা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ভিত্তি। ধ্রুপদি কালে মনে করা হতো ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’র একক রচয়িতা হোমার। কিন্তু অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে গবেষক ও পণ্ডিতদের মধ্যে হোমার একক রচয়িতা কি না তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। এই বিতর্কটি পণ্ডিতদের মধ্যে ‘হোমারীয় প্রশ্ন’ হিসেবে পরিচিত। দুটি মহাকাব্যই হোমারের একক রচনা কি না তা নিয়ে প্রথম ভিন্নমত প্রকাশ করেন মিলান প্যারি, ১৯২০-এর দশকে। তাঁর যুক্তি ছিল, ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ লোকমুখে রচিত কবিতা অর্থাৎ লোককবিতা। তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে গ্রিক সাহিত্যের সনাতনি লোকরীতি অনুসারে এর ভাষাকাঠামো গড়ে উঠেছে। এতে অনুসৃত হয়েছে ঐতিহাসিক কাব্যিক রীতিপদ্ধতি। ঐতিহ্য হিসেবে গ্রিক লোকগাথায় প্রচলিত অনেক বর্ণনাকে হোমার ধার করে বারবার ব্যবহার করেছেন। তাঁর লেখার বহু প্রসঙ্গ বা টুকরা টুকরা ঘটনার নিদর্শন মিলবে গ্রিক লোকসাহিত্যে। আবার দেখা যাবে, দুটি রচনায় একই ঘটনার দুই রকম বা একাধিক বর্ণনা মিলছে, দেখা যাচ্ছে অসংগতি, তবে এগুলোর গঠনকাঠামো, শৈলী ও বিষয়বস্তুর মধ্যে মিল রয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন, নানাজনের মুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রচিত আর প্রচলিত ছিল বলে এই অসংগতি ঘটেছে। একজন যেভাবে পড়েছেন, অন্যজন সেভাবে না পড়ে নতুন কিছু যুক্ত করেছেন অথবা বাদ দিয়েছেন। হোমারের একক কৃতিত্বে তাই মহাকাব্য দুটি রচিত হয়নি। বহু অখ্যাত-অজ্ঞাত লোককবির অবদানে গড়ে উঠেছে ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’। প্যারির ধারণা, হোমার ছিলেন চারণ কবি। তিনি ঘুরে ঘুরে মহাকাব্য পড়ে শোনাতেন। এটিই ছিল তাঁর পেশা। গ্রিক উৎসবগুলোতে যেসব গান গাওয়া হতো, যে গল্পগুলো শোনানোর রীতি প্রচলিত ছিল, তিনি সেগুলোকে নিজের পছন্দের উপযোগী করে আবৃত্তি করতেন। তিনি শিখেছিলেন কিভাবে ওই এপিক গল্পগুলোকে সনাতনি রীতিতে গেঁথে কাব্যে রূপ দেওয়া যায়। প্যারি আসলে গ্রিক কবিতার এসব বিবর্তন ও রূপান্তরের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেই সংশয় প্রকাশ করেছেন যে মহাকাব্য দুটি হোমারের একক রচনা নয়। তবে নিঃসন্দেহে হোমারের কবিপ্রতিভা তাতে যুক্ত করেছিল নতুন মাত্রা। এই দুটি রচনা হোমারের নয়, সেই দাবিও খারিজ হয়ে যায় না। হোমারের গুরুত্বও তাই কমেনি।
তবে এখন গুরুত্ব পায় সেই সময়টি কেমন ছিল অথবা রচনা দুটির অসাধারণ দিকগুলোর ওপর। সমালোচকরা তাঁদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলোও লক্ষ্য করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ ডিন সি হ্যামারের কথা বলা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘ইলিয়াডে কেবল রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অন্তর্গত প্রতিফলন ঘটেনি, রাজনীতিকে উপজীব্য করে আমাদের সামনে হাজির করা হয়েছে। রাজনীতি নিয়ে আমাদের যেসব জিজ্ঞাসা আছে, এ ধরনের উপস্থাপনা সেই দিকটির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।’ ‘কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা’র বিষয়টি ছিল ‘অন্ধকার যুগ’-এর বৈশিষ্ট্য। একে তখন বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা থেকে সরে এসে ক্রমবর্ধমান আন্তনির্ভরশীল রাজনৈতিক সংগঠনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্য পণ্ডিতরা কিভাবে হোমারের রচনাকে কেন্দ্র করে সর্বোত্তম শিক্ষা পাওয়া যেতে পারে, তার ওপর জোর দিয়ে থাকেন।
হোমারের লেখাগুলো কিংবদন্তির ওপর ভিত্তি করে রচিত পৌরাণিক বীরের ট্র্যাজিক গল্প। এটি মানবিক ঐতিহ্যের অংশ, যার অভিঘাত অন্যান্য সংস্কৃতি ও সাহিত্যে মিলবে। এ রকম কয়েকটি দৃষ্টান্ত: ভার্জিলের মহাকাব্য ‘ইনিদ’ (খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক), ক্রিস্টোফার মার্লোর নাটক ‘ড. ফস্টাস’ (১৬০৪), জেমস জয়েসের উপন্যাস ‘ইউলিসিস’ (১৯২২), শামসুর রাহমানের প্রতীকী কবিতা ‘আগামেমনন’। বিশ্বসাহিত্যে এ রকম অসংখ্য রচনা মিলবে, যে রচনাগুলোর অনুপ্রেরণা হয়ে আছে হোমার রচিত অবিস্মরণীয় দুটি মহাকাব্য—‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’।