অর্থ ডেস্ক: আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের আয় বাড়াতে মানুষের ওপর করের জাল বিস্তার করা হয়েছে। ফলে প্রায় সব খাতেই আগের চেয়ে বেশি কর দিতে হবে। কিন্তু মানুষের আয় বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বাড়েনি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ। উলটো শিল্পের সুরক্ষার পরিধি কমেছে।
বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতিতে শিল্পের টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জিং হবে। মূল্যস্ফীতির হারও ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি। আয় কম হওয়ায় মানুষের খরচ হচ্ছে বেশি। বাজেটে করের জালের কারণে মানুষের প্রকৃত আয় আরও কমে যাবে। কারণ আয় থেকে বাড়তি কর দিতে হবে। এতে সংসার চালানোর মতো অর্থের প্রবাহ কমবে।
সূত্র জানায়, দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে গত টানা ৩ বছর ধরে মন্দা চলছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়ে পড়ায় মানুষের আয় কমে গেছে। ডলার সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে দেশে সব পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। ডলারের দাম বাড়ায় টাকার মান কমে গেছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। ফলে মানুষের আয় কমেছে। সঞ্চয় ভাঙছে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়েই গেছে যে, সংসার চালাতে হাঁপিয়ে উঠেছে মানুষ। এ অবস্থায় মানুষ একটু স্বস্তি পেতে সরকারের কাছে বাজেটে করের চাপ কমানো, পণ্যমূল্য সহনীয় রাখা ও আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু বাজেটে সরকার সেসব খাতে নজর দিয়েছে একেবারেই কম। উলটো আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের চাপে করের জাল বাড়িয়েছে, ডলারের দাম আরও বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। বাড়বে ঋণের সুদের হার। ফলে ব্যবসার খরচ বাড়বে। এতে পণ্যের দাম আরও এক দফা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া আয়কর ও ভ্যাটের জাল বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাব সব খাতে পড়বে এবং মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দেবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) হিসাবে দেখা যায়, এপ্রিলে জাতীয়ভাবে মানুষের মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। একই সময়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়েছে ২ দশমিক ০১ শতাংশ। অর্থাৎ মানুষ যা আয় করছে, খরচ হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। ফলে মানুষকে সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে। যাদের সঞ্চয় নেই তাদের ঋণগ্রস্ত হতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক মন্দায় স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের এখন মাসিক উপার্জনের চেয়ে খরচ বেশি হচ্ছে। এভাবে বেশি দিন টিকে থাকা যায় না। কিছু দিন সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালায়। তারপর ঋণ করে। এরপর আর কোনো পথ না থাকলে মানুষ পিছু হটে। যে কারণে অনেকে খরচ কমাতে জীবনযাত্রার ব্যয় কাটছাঁট করছেন। কম ভাড়ার বাসায় ওঠছেন। শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন। পুষ্টিকর খাবার কম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় করের চাপ বাড়ানো ঠিক হয়নি।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার আয় বাড়াতে চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৬৭ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে কর বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে ২২ দশমিক ২২ শতাংশ। সরকারি খাতের বিভিন্ন সেবা ও ফি থেকে এসব রাজস্ব আদায় হয়। ফলে এ খাতে গ্রাহকদের খরচ বাড়বে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ। ফলে এনবিআর যেসব খাতে কর আদায় করে সেগুলোর ভার মানুষের ওপর আরও বেশি পড়বে। এনবিআর নিয়ন্ত্রিত করের মধ্যে মানুষের কাছ থেকে সরাসরি আদায় করা হয় আয়কর। এ খাতে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে ২৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা সবচেয়ে বেশি। ফলে মানুষের কাছ থেকে কর আদায় বেশি করবে সরকার। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি খাতের ২৪ ধরনের সেবা নিতে আয়কর রিটার্ন স্লিপ জমা দিতে হবে। রিটার্ন স্লিপ আগে কোনো কর ছাড়াই নেওয়া যেত। তবে আগামী অর্থবছর থেকে রিটার্ন স্লিপ নিতে লাগবে ২ হাজার টাকা। অর্থাৎ করযোগ্য আয় না থাকলেও তাকে সেবা নিতে হলে ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। এ ধরনের কর আরোপকে জনগণের প্রতি অন্যায় আচরণ বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি। আয়কর খাতেই সরকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছে। মূল্যসংযোজন কর বা ভ্যাট খাতে বাড়ানো হয়েছে ১২ দশমিক ০৪ শতাংশ। এটি এনবিআর সেবাদাতার মাধ্যমে ভোক্তার কাছ থেকে আদায় করে। মূলত ভ্যাট ও আয়কর থেকেই এনবিআর ৭৫ শতাংশ কর আদায় করে। ফলে ভোক্তার কাঁধেই করের চাপ বেশি পড়ছে।
বাকি ২৫ শতাংশ অন্যান্য খাত থেকে। আমদানি ও স্থানীয় শিল্পের সম্পূরক শুল্ক থেকে আদায় প্রায় ২৪ শতাংশ। সম্পূরক শুল্ক বেড়েছে ১৩ দশমিক ০৯ শতাংশ, আমদানি শুল্ক বেড়েছে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এতে শিল্প ও আমদানি পণ্যের খরচ বাড়বে। এর প্রভাবে বাড়বে পণ্যের দাম। যার চাপ ভোক্তার ওপরই পড়বে।
এনবিআর ব্যাংক আমানতের ওপর থেকে নিদর্ধারিত হারে আবগারি কর আদায় করে। গ্রাহকদের হিসাবে বছরে ১০ লাখ টাকার বেশি লেনদেন হলেই আবগারি কর দিতে হয়। এ খাতে কর বেড়েছে ১৬ দশমিক ১৯ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরে সরকার মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে সীমিত রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু আইএমএফ’র মতে, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি হার সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকবে। এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে ওঠেছে। মে মাসে পণ্যের দাম আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। বাজেটের প্রভাবে জুনেও এক দফা বাড়বে। জুলাই থেকে ডলারের দাম ও সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হবে। ফলে ডলারের দামও বাড়বে, ঋণের সুদও বৃদ্ধি পাবে। এর প্রভাবে পণ্যমূল্যও বাড়বে। ফলে জুলাই পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যদিও পণ্যমূল্য বাড়লেও মূল্যস্ফীতির হার কমে যাওয়ার নজির রয়েছে। আগে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে, শহরে কম। এপ্রিলে শহরে বেশি বেড়েছে, গ্রামে তুলনামূলক কম বেড়েছে। ওই মাসে শহরে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও গ্রামে ৮ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বিবিএস’র হিসাবে এপ্রিলে ঢাকা বিভাগের মানুষের মজুরি ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়েছে। ওই সময়ে ঢাকায় মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা। কারণ পণ্যমূল্য ও টাকার প্রবাহ ঢাকা শহরেই বেশি। চট্টগ্রামে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ, খুলনায় ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ, বরিশালে ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, সিলেটে ৭ দশমিক ০১ শতাংশ আয় বেড়েছে। রংপুরের মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার দেখনো হয়েছে ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
ওই সময়ে কৃষি খাতে মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ, শিল্প খাতে ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও সেবা খাতে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। আয় বাড়ার হেরফের হলেও মূল্যস্ফীতির হার সব খাতেই আঘাত করেছে।