-জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা
বাবুল চন্দ্র সূত্রধর: বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা, যা এসেছিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। বিশেষ করে এমন কিছু গুণী মানুষ এতে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন, যাঁদেরকে শহিদ বুদ্ধিজীবী বলে সর্বত্র শ্রদ্ধা করা হয়। তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে যোদ্ধা ছিলেন না কিন্তু বিশ্বাস ও কথাবার্তা ছিল মানুষের স্বাধীনতা, মানবিকতার অবাধ বিকাশ এবং সর্বোপরি মানুষের ন্যায়সংগত ও যুক্তিশীল অধিকার সংরক্ষণের পক্ষে।
তাঁদেরই অন্যতম এক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, যিনি ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাত্রিতে বর্বর পাক-হানাদার বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্রে বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন ও ৩০শে মার্চ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার জীবন ও কর্মকে চির জাগরূক করে রাখার মানসে ‘জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা স্মারকগ্রন্থ’ চয়নের কথা চিন্তা করেন অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম ও ড. রংগলাল সেন। এ কাজে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা ও কন্যা মেঘনা গুহঠাকুরতা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন, যা সম্পাদকরা ভূমিকাংশে উল্লেখ করেন। ২৩০ পৃষ্ঠার এই স্মারকগ্রন্থটি বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদ করেন সমর মজুমদার।
মোট ১৯ জন শ্রদ্ধেয় লেখকের মধ্য থেকে ক’জনের কথা আংশিকভাবে তুলে ধরতেই হয়: বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন ড. গুহঠাকুরতার সহপাঠী ও বাল্যবন্ধু; তাঁর লেখায় আছে, ‘জ্যোতির্ময় কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর দান করে বিশ্ববাসীকে চমৎকৃত করেননি কিংবা কোনো দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দান করেননি।
কিন্তু শিল্পী যেমন তুলি দিয়ে ছবি আঁকেন, তাঁর একটি আঁচড়ে সব সম্ভাবনার ইঙ্গিত থাকে, কবি যেমন অনায়াসে শব্দের পর শব্দ যোজন করে হৃদয়কে করেন আলোকিত, জ্যোতির্ময় তেমনি একটি নিখুঁত সুন্দর কালিমাহীন কাব্যময় জীবন যাপন করে গেছেন। তাঁর জীবনের প্রত্যেকটি দিন কবিতার একটি নতুন পঙক্তি, শিল্পের একটি নতুন রেখা। পদ বা অর্থলোভের ঊর্ধ্বে নির্লিপ্ত ও নিস্পৃহ জীবন মানুষকে আত্মগৌরবে ভূষিত করে, তার সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন।’
মানবতাবাদী সমাজ-দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, জাতীয় অধ্যাপক ও ড. গুহঠাকুরতার আদর্শিক বন্ধু ড. সালাহউদ্দীন আহমদ লিখেছেন, ‘অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ছিলেন একজন আদর্শ মানবতাবাদী। তাঁর মধ্যে ছিল অটুট ও অফুরন্ত আশাবাদ। কোনো অবস্থায় মানুষের ওপর বিশ্বাস তিনি হারাননি। গুলির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে যখন তিনি মৃত্যুপথযাত্রী, তখনো তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যে উন্মত্ত হিংসা ও বিদ্বেষের শিকার তিনি নিজে হয়েছেন, সে হিংসা ও বিদ্বেষ একদিন দূর হবে; মানুষ তার সৃজনশীল প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে এক নতুন সুন্দরতর পৃথিবী সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত, উপাচার্য ও সাহিত্যিক অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন ড. গুহঠাকুরতার সহকর্মী; তিনি লেখেন, ‘জ্যোতির্ময়ের মনের বলয়ে অনেক আলোবাতাস ছিল, তার সংস্কৃতি ছিল উদার। আমি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত শিষ্টাচার, সুরুচি ও হৃদয়তার কথা ভাবছি না, যদিও দুইই ছিল উল্লেখ করার মতো।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাহিত্যিক অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ছিলেন ড. গুহঠাকুরতার প্রত্যক্ষ ছাত্র। তাঁর কথায়, ‘এদেশে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে যে দূরত্ব একপক্ষে ঔদাসীন্য অন্যপক্ষে সমীহ, এটাকে তিনি একেবারেই মিথ্যা করে দিয়েছিলেন। নিজেকে তিনি ধরা দিতেন তাঁর পূর্ণ পরিচয়ে। বিষয় বহির্ভূত আলোচনা, সংগীত, নাটক, ফুলের চাষ তাঁর সব আগ্রহ অভীপ্সা প্রবণতা নিয়ে গোটা মানুষটিকে আমরা পেয়েছি তাঁর নিজের তৈরি অন্তরঙ্গতার জগতে এবং তাঁর কৌতূহলও খুঁজে বেড়াত শ্রেণিকক্ষের একজন ছাত্রকে নয়, ছাত্রের মধ্যে যে গোটা মানুষটি আছে, তাঁকে।’
শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে অধ্যাপক গুহঠাকুরতার ছিল আদর্শিক মিত্রতা, উভয়েই প্রখ্যাত মানবতাবাদী এম এন রায়ের অনুসারী ছিলেন। শ্রী শিবনারায়ণের লেখায়, “মানবতন্ত্র নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। ‘আমি মানুষ, সুতরাং কোনো মানুষই আমার অনাত্মীয় নয়’-এই বিখ্যাত উক্তি তিনি পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করতেন।…বুদ্ধির মুক্তি, বিবেকের উজ্জীবন, সমবেত প্রয়াসে সমাজের সংস্কার সাধন-এই পদ্ধতিকেই তিনি মানবীয় উৎকর্ষের উপযোগী মনে করতেন।”
গুহঠাকুরতার প্রত্যক্ষ ছাত্র ও খ্যাতিমান অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায়, ‘(জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা) ছাত্রদেরকে শেখাতেন মনোযোগ দিয়ে, প্রখর ছিল মেধা, স্পষ্ট ছিল উচ্চারণ, আকর্ষণীয় ছিল ব্যক্তিত্ব। কেবল জ্ঞান পাওয়া যেত না, জানবার আগ্রহটাও তৈরি হতো প্রচুর পরিমাণে। নিজের অধ্যয়নকে বড় সহজভাবে বহন করতেন তিনি। মনে হতো না বিদ্যার ভারে বিবৃত।…যুক্তিবাদী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু বড়ই কোমল ছিলেন ভেতরে ভেতরে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন, ‘তাঁর (জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা) কথার মধ্যে প্রগতি, মানবিকতা, মুক্তি শব্দগুলি ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে আসত। এখন বুঝি পঞ্চাশ দশকের যুক্তিবিরোধী সাস্প্রদায়িক ধর্মান্ধ পরিমণ্ডলে ঐ কথাগুলো ভিন্নতর জীবন নির্মাণের জন্য কেন এত প্রয়োজনীয় ছিল।…তিনি বুদ্ধিবাদী অন্বেষার কথা বলতেন। বুদ্ধিবাদী অন্বেষা ছাড়া দেশ এগোয় না, সমাজের বদল হয় না।’
অধ্যাপক গুহঠাকুরতার ছাত্র ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক শেখ আবদুল ওয়াহাব-এর কথায়, ‘তরুণ সমাজের ওপর স্যারের দারুণ আস্থা ও আশা ছিল। তাদের উচ্ছলতা, খেয়াল, তৎপরতা এবং স্বচ্ছদৃষ্টির মধ্যেই যে সমাজমুক্তির বীজ এবং ভবিষ্যৎ মঙ্গল লুকানো আছে তা তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। তাই শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও প্রায়ই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রাণ-উচ্ছল ছাত্রছাত্রীদের কাছে ডেকে নিয়ে কথা বলতেন, প্রশ্ন করতেন, শুনতেন, পালটা প্রশ্ন করতেন এবং সহজভাবে তাঁর বাসায় তাদের চায়ের আমন্ত্রণ জানাতেন।’
ফজলে লোহানীর কথায়, “জ্যোতির্ময় বাবু রোমান দার্শনিক সিসেরোর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রায়ই বলতেন, ‘সালুস পপুলি সুপ্রিমা এস্ত লেকস্’ মানুষের মঙ্গলই হচ্ছে সর্বপ্রধান আইন। জ্যোতির্ময় বাবু এ দেশকে ভালোবেসেছিলেন। এটা তাঁর জন্মভূমি। এ দেশ ছেড়ে তিনি পলাতক হননি।”
গ্রন্থটির শুরুতে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কীর্তিময় জীবনালেখ্য উপস্থাপন করে তাঁর লেখা নির্বাচিত ৭টি মূল্যবান ও পাঠক-নন্দিত প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রবন্ধগুলো অধ্যয়ন করলে ব্যক্তি জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার চিন্তার বিশালতা ও মননশীলতার প্রসারতা তথা মানবতার প্রতি নিঃশর্ত দায়িত্ববোধের বিষয়টি সকলের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
গ্রন্থটির শেষভাগে স্থান পেয়েছে ক’টি চিঠি, যেগুলো ব্যক্তিগত হলেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও পঠনযোগ্য। তবে যতদূর জানি, এই মূল্যবান গ্রন্থটি এখন আর বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সদয় বিবেচনায় আনতে পারেন; অথবা বাংলা একাডেমির অনুমতি নিয়ে অন্য কোনো সহৃদয় প্রকাশক এর পুনঃপ্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।