আহমদ আবদুল্লাহ
বিশ্বের যত তাবৎ ভাষা এবং তার অভিযাত্রার পার্বিক পরিসংখ্যান করা হয়েছে। দেখা গেছে, বাংলা ভিন্ন অন্য সব ভাষার প্রথম বই’ই মৌলিকত্ব বর্জিত, ত্রুটিপূর্ণ এবং কৃত্রিম বা অনূদিত। যেমন ইংরেজি ভাষার প্রথম বই-‘দি রিক্যয়েল অফ দি হিস্টোরিস অফ ট্রয়’ এটি অনূদিত গ্রন্থ। কাক্সটন রচিত মূল ফরাসি ভাষা থেকে অনূদিত ও ব্রুজেমে মুদ্রিত এ বইখানি ইংরেজি ভাষার অভিযাত্রা সূচিত করেছে। এর মধ্যে খানিকটা ইতিহাস, কিঞ্চিৎ কল্পনা, ন্যূনাধিক যুদ্ধ আগ্রাসন জেনোসাইড ইত্যাদি জিঘাংসাবৃত্তির রকমারি বিসম্বাদ ঘোরতরভাবে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। এতে হৃদয়বৃত্তির কোনো ছোঁয়া নেই, নেই কোনো জীবনঘনিষ্ঠ প্রত্যয়ী কথামালা। আছে খুব শক্তির পরীক্ষা, রক্ত দেওয়া নেওয়ার আতঙ্ক ও উন্মাদনা।
বাংলাভাষার প্রথম বই ‘চর্যাপদ’ বা ‘চর্যাগীতি’ বা ‘মিস্টিক সঙস’ ত্রিপাঠ এবং বেধ এক অনবদ্য সৃষ্টি। চর্যাপদের তুলনা একমাত্র চর্যাপদই হতে পারে। বিষয়টি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। চর্যাপদের শ্লোকগুলো পাঠ করলে হয় মন্ত্র, আবৃত্তি করলে হয় কবিতা, সুর দিলে হয় গান। এমন একখানা বই পৃথিবীর কোনো জাতির হাতে নেই।
মানুষ সমাজ জীবন জীবিকা প্রেম ভালোবাসা সুখ দুঃখ অভাব অনটন ক্ষুধা দৈন্য আশা নিরাশা হতাশা, এসব অতীব গার্হস্থ্য জীবনের ধূসরিত চিত্র অঙ্কিত এবং বিধৃত হয়েছে এই স্বপ্নিল গ্রন্থ চর্যাপদের সোনালি শরীরজুড়ে।
অন্যদিক থেকে দ্যাখা যায় যে, চুরাশিজন সিদ্ধাপুরুষ বৌদ্ধ সহজিয়াদের ‘বিভূতি’ সাধন মার্গের অষ্ট প্রকার যোগ লব্ধ ঐশ্বর্য অর্জনের আরাধনা (অনিমা লঘিমা ব্যাপ্তি প্রাকাম্য মহিমা ইশ্বর বশিত্ব কামাবশায়িতা) মতাবলম্বী চব্বিশ জন একনিষ্ঠ সাধক কবি (প্রাপ্ত পদকার তেইশজন) রচিত এই তত্ত্ব ও অলক্ত গ্রন্থ চর্যাপদ। চর্যাপদের ভাষা ‘আলো-আঁধারি’ বলে যে অতি কথনটি উপ্ত হয়েছে, তা একান্তই অতিশয়োক্তি ছাড়া কিছু নয়। একটা ভাষার দেড় হাজার বছর আগের রূপ দেড় হাজার বছর পরের মানুষের কাছে ‘আলো-আঁধারি’ মনে হওয়ার যুক্তিটি অযৌক্তিকভাবে যুক্তিগ্রাহ্য হিসাবে প্রমিত করার দাবিও উঠেছে। তবে চর্যাপদের পাঠোদ্ধার কাজটিই প্রমাণ করে যে, আঁধার কেটে গিয়ে আলোকময় হয়ে উঠেছে চর্যাপদ।
পৃথিবীর প্রথম ভাষা ‘হায়ারোগ্লিফিক’, ‘অ্যাংলো সাকসন’, ‘ইন্দো-ইয়োরোপিয়ান প্যারেন্ট স্পিচ’ ইত্যাদি থেকে এই অদ্যকালবধি বিস্তরিত ভাষা উপভাষার মধ্যে একমাত্র বাংলাই এক অনন্য ভাষা, যা উনিশ থেকে ন্যূনাধিক ত্রিশটি ভাষাকে শোষণ (হজম) করেছে। অনন্তর অগ্র পথে এই ভাষাই শোষণের শিকার। তবে শোষিত না হলে কোনো ভাষাই সমৃদ্ধ হয় না। পাল রাজা, সেন রাজাদের আমলে বাংলা সমৃদ্ধ হয়েছে বৈদিক শব্দ গ্রহণের মাধ্যমে, তুর্কি বিজয়ের পর মধ্যযুগীয় মুসলিম শাসনামলে আরবি ফারসি হিন্দি এবং আরব্য ও মধ্য প্রাচ্যসহ মিসরীয় ভাষা গোষ্ঠীর ভাষার শব্দ গ্রহণের মাধ্যমে, ব্রিটিশ আগ্রাসনের পর ইংরেজিসহ অ্যাংলো সাকসন ভাষা গোষ্ঠীর ভাষার শব্দ গ্রহণের মাধ্যমে এবং ব্রিটিশ পরবর্তী সময়ে দুই বাংলাই আগ্রাসন শোষণ জেনোসাইডরূপ প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকের দমন পেষণের ক্ষত নিয়ে বাংলাভাষা হয়েছে আরও সমৃদ্ধ, অধিক প্রতিবাদী, বিপুল সংগ্রামী, ত্যাগী ও আত্মপ্রত্যয়ী। অর্থাৎ বাংলাভাষার ওপর যত আঘাত এসেছে, ততোই বাংলা খ্ািট বাংলা হয়ে উঠেছে। বাংলা তার সমহিমায় উদ্ভাসিত, বিশ্ববিস্মৃত। বাংলাভাষার এ অভূতপূর্ব বিজয় একবার হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘নোবেল’ প্রাপ্তিতে, আরেকবার হলো বাঙালি পূর্বাঞ্চলীয় জনতার ভাষা আন্দোলন তথা জেনোসাইডবিরোধী জীবনপাত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ‘নোবেল’ প্রাপ্তিটা ছিল বিশ্বময় বাংলাভাষার পরিচিতি মাত্র আর ভাষা আন্দোলন হলো বাংলাভাষাকে মাতৃভাষা রূপে গোটা বিশ্বের স্বীকৃতি। বাংলাভাষা হয়ে গেলো বিশ্ব জনতার আত্মার ভাষা। তাই উন্মুখ হয়ে বলতে চাই আমার বাংলাভাষার ফাউন্ডেশন ‘চর্যাপদ’।