হযরত রাসুল (সা.)-এর যুগে মুসলিম নারীদের চিকিৎসাসেবা

হযরত রাসুল (সা.)-এর যুগে মুসলিম নারীদের চিকিৎসাসেবা

মুফতি ইবরাহিম সুলতান: ইসলামের প্রথম যুগে নবিজি (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে নারীরা অসুস্থদের সেবা ও সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন। সেই সময় নার্সিংবিদ্যায় নারীদের বিশেষ অবদানও ছিল উল্লেখযোগ্য। নারী গবেষক ড. জান রাফাত ‘ইসলামের ইতিহাসে চিকিৎসাবিদ্যা’ নামক প্রবন্ধে ইসলামের সর্ব প্রথম নার্স সাহাবি রুফাইদা আল-আসলামি সম্পর্কে লিখেন, রুফাইদা (রা.)-এর পিতা ছিলেন সাআদ আল-আসলামি। যিনি নবুয়তের ১১তম সালে মদিনা মুনাওয়ারার একমাত্র দক্ষ ও প্রসিদ্ধ চিকিৎসক ছিলেন। তিনি সে সময় তাঁর পিতার সহায়তা করতেন। আর এভাবেই তিনি নার্সিংবিদ্যার দক্ষতা ও কৌশল রপ্ত করেন। ধীরে ধীরে নার্সিং ও চিকিৎসা শাস্ত্রের ক্রমবিকাশ ঘটে।


সবশেষে গবেষক ড. রাফাত আরো বলেন, রুফাইদা (রা.) নবিজির ব্যাপারে জানামাত্রই ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর নবি (সা.) তাঁকে নার্সিং কার্যক্রম চালিয়ে যেতে অনুমতি দেন। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত আছে যে তিনি স্বীয় পেশায় নিষ্ঠাবান ও ধৈর্যশীলা ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ তথা সেবাদানের ভিত তৈরি করেছিলেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সৃষ্টির সেবায় তিনি মুসলিম নারীদের জন্য এক অকল্পনীয় দৃষ্টান্ত। সমাজসেবায় পর্দা রক্ষা করে মহিলাদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ প্রদানে হযরত রুফাইদা (রা.)-এর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, খন্দকের যুদ্ধের দিন সাআদ (রা.)-এর চোখ আঘাতপ্রাপ্ত হলে এবং তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে রুফাইদা নামক এক মহিলার কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো। তিনি আহতের চিকিৎসা করতেন। নবী (সা.) সকাল-সন্ধ্যায় সাআদ (রা.)-এর কাছ দিয়ে যেতে জিজ্ঞেস করতেন, তোমার দিন কেমন কাটল, তোমার রাত কেমন কাটল? তিনি তাঁকে (নিজ অবস্থা) অবহিত করতেন। (আদবুল মুফরাদ, হাদিস- ১১৩৯)


তাছাড়া খাইবার যুদ্ধে আহত মুসলিম মুজাহিদদের সুস্থ করতে তিনি মাতৃত্বের মমতাময়ী হাত বাড়িয়ে দেন। তাঁর এই অবিস্মরণীয় ত্যাগ এবং সেবা-শুশ্রæষার স্বীকৃতিস্বরূপ হযরত রাসুল (সা.) পুরুষ মুজাহিদদের সঙ্গে তাঁকেও গণিমতের মালের অংশ দিয়েছিলেন। আজকের বিশ্বেও তিনি নারী চিকিৎসক ও নার্সদের আইডল হয়ে আছেন।
এছাড়া নবির যুগে যেসব নারী নার্সিং ও সেবাদানে নিয়োজিত ছিলেন তাদের মধ্যে হযরত উম্মে আতিয়াহ আল আনসারি (রা.) অন্যতম।


মহীয়সী এই নারী রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি সেখানে যুদ্ধাহত সাহাবায়ে কেরামের সেবা করতেন। অর্থাৎ নার্সের দায়িত্ব পালন করতেন। সেসময়ের ঘটনা তিনি নিজেই বর্ণনা করে বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ৭টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমি তাঁদের সাওয়ারি ও মালপত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পশ্চাতে থাকতাম, তাঁদের খাবার তৈরি করতাম, আহতদের চিকিৎসা করতাম এবং রোগীদের দেখাশোনা করতাম।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৮৫৬)


ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আরেক নার্সিং সাহাবির নাম উম্মে সুলাইম (রা.)। যুদ্ধাহত সাহাবায়ে কেরামকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তিনি ওহুদ, খায়বার ও হুনাইন ছাড়াও উম্মে সুলাইম (রা.) অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মশক ভরে পানি আনতেন। আহতদের পানি পান করাতেন, ছাতু গুলিয়ে দিতেন, তীর উঠিয়ে দিতেন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসার সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করতেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মে সুলাইমকে এবং কিছুসংখ্যক আনসার মহিলাকে যুদ্ধে নিয়ে যেতেন। তাঁরা মুজাহিদদের পানি সরবরাহ করতেন এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। (আবু দাউদ, হাদিস ২৫৩১)


অন্য বর্ণনায় আনাস (রা.) থেকে উহুদ যুদ্ধের এক দীর্ঘ হাদিসে বর্ণিত আছে, আবু তালহা বলেন, আমি সেদিন আবু বকরের কন্যা আয়েশা ও উম্মে সুলাইমকে এমন অবস্থায় দেখেছি, তাঁরা তাঁদের পিঠে পানির মশক বয়ে আনছিলেন। তখন তাঁরা এমনভাবে কাপড় গুছিয়ে চলছিলেন যে আমি তাদের পায়ে পরিহিত অলংকার দেখতে পাচ্ছিলাম। তাঁরা আহতদের মুখে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন। তাঁরা আবার গিয়ে মশক ভরে পানি এনে আহতদের মুখে পানি দিচ্ছিলেন। (মুসলিম, হাদিস ৪৫৭৭)


নবীজি (সা.)-এর চিরশত্রু আবু জাহেলের হত্যাকারী মুআউয়াজ (রা.)-এর কন্যা রুবাইয়িও ছিলেন নার্স সাহাবিদের অন্যতম। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমরা (যুদ্ধের ময়দানে) নবি (সা.)-এর সঙ্গে থেকে লোকদের পানি পান করতাম, আহতদের পরিচর্যা করতাম এবং নিহতদের মদিনায় পাঠাতাম।’ (বুখারি, হাদিস ২৮৮২)
তাই ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে শরিয়তি পর্দা রক্ষা করে চিকিৎসাসেবায় নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ করা উচিত।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *