মূল্যস্ফীতি কমানো ও বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নই বড় চ্যালেঞ্জ- ড. জাহিদ হোসেন

মূল্যস্ফীতি কমানো ও বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নই বড় চ্যালেঞ্জ- ড. জাহিদ হোসেন

অর্থ ডেস্ক: করোনা ভাইরাস মহামারির ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেক ধাক্কা লাগে দেশের অর্থনীতিতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থায় পড়ে যায়। সেই নেতিবাচক প্রভাব এখনো চলছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সমাগত। তাই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট তৈরি হচ্ছে নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে।


বিশেষ এই পরিস্থিতিতে কেমন হবে আগামীর সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব। এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা। এ অবস্থায় কেমন হওয়া উচিত নতুন বাজেট। কী ধরনের চ্যালেঞ্জই বা আসছে। এসব খুঁটিনাটি নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট হতে হবে ব্যতিক্রমধর্মী ও ঝুঁকি মোকাবিলার বাজেট। কেননা মূল্যস্ফীতি কমানো ও বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নই বড় চ্যালেঞ্জ হবে।


আগামী অর্থবছরের বাজেট কেমন হওয়া দরকার?-এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ঝুঁকির বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা উচিত। এরপর সেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কেননা এখন বড় সমস্যা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখা, তীব্র ডলার সংকট ইত্যাদি। এ অবস্থায় ভাবতে হবে বাজেটে কোনটিকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। এখন কথা হচ্ছে প্রথমত, সামষ্টিক ঘাটতি অর্থায়ন নিয়ে। দ্বিতীয়ত, এই ঘাটতির দুটো দিক আছে। রাজস্ব আদায় এবং সরকারি ব্যয় কাঠামো ঠিক করা। তৃতীয়ত, বাজেট তো শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, এটি সরকারি অর্থনৈতিক কর্মধারা এবং নীতিমালা সংস্কার কী হতে যাচ্ছে সেসব দিকও থাকে। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের দুটো জিনিস প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব দেখা যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল সমস্যা হিসাবে মূল্যস্ফীতি কমানোটাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হলেও মানতে হবে।


বর্তমান প্রবৃদ্ধি নিয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেট ঘাটতি শুধু জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বলে দিলাম ব্যাপারটা তা নয়। এটা করলে চলবে না। কেননা ঘাটতি অর্থায়নের প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। এখন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণ ৯০ শতাংশের বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া। এর ফলে মূল্যস্ফীতি কমেনি, বরং বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। আগামী বাজেটে ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখলেও খেয়াল রাখতে হবে ওই ঘাটতি অর্থায়ন যাতে খুব বেশি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে না হয়। সেদিকটা ভালোভাবে দেখতে হবে। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম হলেও সেটি মানতে হবে। কেননা বড় সমস্যা সমাধানে মূল্যস্ফীতি কমানোই মূল কথা। ঘাটতি অর্থ আসবে কীভাবে সে বিষয়ে বলতে গিয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বৈদেশিক ঋণের যে প্রতিশ্রæত অর্থ আছে তার খরচ বাড়াতে হবে। এখন বছরে বৈদেশিক অর্থ থেকে ১৫ শতাংশ ও তার কম খরচের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে যেসব প্রকল্পে সহজ শর্তের বৈদেশিক ঋণ আছে সেসব বাস্তবায়নে গতি বৃদ্ধি করতে হবে।


রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, রাজস্ব আদায় বিষয়ে আইএমএফের কাছে একটা কমিটমেন্ট দেওয়া আছে। তবে বর্তমান অর্থবছরে এনবিআরের অংশে রাজস্ব আদায় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো ঘাটতি থাকতে পারে। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরের রাজস্ব আদায় জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে কীভাবে? এছাড়া সেটি বাড়ানোর জন্য কী কী সংস্কার করা হবে সেসব বিষয় বাজেটে স্পষ্ট করা দরকার। তবে বলা হচ্ছে কর অবকাশ সুবিধা কমানো হবে। কিন্তু সেটা কতটা সুবিধা হবে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। চলমান সুবিধা কমাতে এনবিআর কতটুকু হাত দিতে পারবে। এক্ষেত্রে লুফল্ট (ফাঁকফোকর) বন্ধ না করলে আসলে কিছুই হবে না। যেমন আয়কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। ভ্যাট আদায়ে প্রশাসনিক সংস্থার ও করনীতির সংস্কার করা প্রয়োজন। ভ্যাটের রেট, আয়কর ও করপোরেট কর সংস্কার করা উচিত। এদিকে কর হার কমিয়ে করজাল বাড়িয়েও কাজ হবে না। তাই পলিসি রিফর্ম, প্রশাসনিক দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।


সরকারি ব্যয় নিয়ে ড. জাহিদ হোসেন মন্তব্য করেন যে, আগামী অর্থবছরে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ধারায় চললে হবে না। এডিপিতে অর্থ খরচে সাশ্রয় করা দরকার। ভর্তুকি কমানোর সুযোগ আছে। কিন্তু সরকারি রাজস্ব ব্যয় অর্থাৎ কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কমানোর তো সুযোগ নেই। এর আগে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ, তেল এবং গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। সেটার জন্য কিছুটা ভর্তুকি ব্যয় কমেছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ তো বাড়ছে। এজন্য কস্ট রিডাকশনেরও উদ্যোগ থাকতে হবে। বিপিসি, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের লোকসান কীভাবে কমানো যাবে? বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে টাকা দেওয়া হচ্ছে। সংস্কারের মাধ্যমে ভর্তুকি কমানোর ক্ষেত্রে এ রমক বড় বড় বিষয়ে হাত দিতে হবে। এছাড়া বড়-ছোট নানা প্রকল্প আছে। দেখা যাচ্ছে এডিপিতে পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে আগের মতোই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ডলার সংকটের এই সময়ে বরাদ্দের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ ছিল। আগামী অর্থবছর যেসব বড় প্রকল্পে বিদেশি অর্থায়ন নেই সেগুলোতে গুরুত্ব কম দেওয়া দরকার।


নতুন বাজেটে কোন কোন দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন এবং সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপগুলো বাজেটে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ক্ষেত্রেও সংস্কার দরকার। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে দেখা যায় সরকারি অংশের টাকা দ্রুত খরচ করা হয়। কিন্তু বৈদেশিক অর্থ ব্যয় করতে গেলে নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলে সংশ্লিষ্টরা উৎসাহ দেখায় না। এ বিষয়টিতে নজর রাখতে হবে। চলমান ঝুঁকি কমাতে কস্ট রিডাকশনের মাধ্যমে ভর্তুকি কমানোর চ্যালেঞ্জ থাকবে আগামী অর্থবছরে। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে কিছুই হবে না।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *