অনলাইন ডেস্ক: সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও বার্ধক্য ধেয়ে আসছে। জীবনযাত্রা উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে, কমছে প্রজনন হার। এতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ২০৪৭ সাল নাগাদ ‘ওল্ড সোসাইটি’তে পরিণত হবে। চিকিৎসাসেবা উন্নত হওয়ায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও প্রবীণ মানুষ এখন দীর্ঘদিন বেঁচে থাকছেন। ২০২২-এর জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯। তারা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। আবার বয়স বাড়ার সঙ্গে মানুষের একাকিত্ব ও অসহায়ত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবীণ পুরুষের তুলনায় প্রবীণ নারীরা বেশি নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। এমনকি দেশে প্রবীণদের জন্য সরকারিভাবে বিশেষায়িত হাসপাতাল হাতে গোনা, তাদের জন্য সেভাবে আবাসন ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি।
এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, বাংলাদেশে ৮০ বছরের ওপর জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ নিয়ে কোনো রকমের প্রস্তুতি বা চিন্তাভাবনা কারও মধ্যে নেই। তাই গণমাধ্যম, শিক্ষাব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মসজিদের ইমামও এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে পারেন। প্রবীণদের জন্য ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ করা যেতে পারে। যদিও এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মসূচি নেই। স্বাস্থ্য, তথ্য, শিক্ষা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যদি এ বিষয়ে উদ্যোগ না নেয়- তাহলে এ সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না। সূত্র মতে, প্রবীণদের জন্য একটি কমিউনিটি গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ছাড়া বয়স্কদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে গবেষণাও প্রয়োজন, যার ভিত্তিতে পলিসি তৈরি করে তার বাস্তবায়ন করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা কিছু বৃদ্ধাশ্রমে খুব অল্পসংখ্যক প্রবীণের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৮৫টি শিশু পরিবার আছে। এর মধ্যে ছেলে শিশুদের জন্য ৪৩টি পরিবারে ১০ জন করে পুরুষ আর মেয়ে শিশুদের জন্য ৪১টি পরিবার রয়েছে, সেখানেও ১০ জন করে প্রবীণ নারী থাকতে পারবেন। এ ছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত ছয় বিভাগে ৬টি প্রবীণ নিবাস আছে। এই নিবাসগুলোতে ৫০ জন করে থাকার সুযোগ আছে। বেসরকারিভাবে বেশ কয়েকটি প্রবীণ নিবাস থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
বাংলাদেশের জনমিতি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩৫ থেকে ৩৭ সালের পর থেকেই তরুণদের তুলনায় ক্রমশ বয়স্কদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং ২০৪৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পরিণত হবে বয়স্কদের সোসাইটিতে।
একটি তথ্যানুযায়ী, রংপুরের এক সরকারি কর্মকর্তা শরিফুল হক তার জীবনের সব সঞ্চয় একমাত্র ছেলের বড় হওয়ার পেছনে খরচ করেছেন। এসএসসির পর ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য ছেলেকে ঢাকায় পাঠান। এরপর দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য অবসরের পর এককালীন যে ভাতা পেয়েছেন তার পুরোটাই খরচ করেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সেই ছেলে বাবাকে দাফন করতে দেশে আসেনি। এমনকি বাড়িতে এখন শরিফুলের অসুস্থ স্ত্রী একা থাকছেন। এই মা তার ছেলেকে দেখতে চান, কিন্তু ছেলে আর দেশে ফিরবে- সেই সম্ভাবনা নেই। ছেলেকে ছাড়াই শেষ বয়সে এখন মৃত্যুর পথ গুনছেন এই প্রবীণ নারী।
সূত্র মতে, বার্ধক্য নিয়ে মানুষের নিজেদের মধ্যে যেমন কোনো প্রস্তুতি নেই, একইভাবে প্রবীণদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। শহর বা গ্রামে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার তৈরি হওয়ায় এখন বয়স্কদের উল্লেখযোগ্য অংশ শেষ বয়সে এসে প্রবীণ নিবাসে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশে হাতেগোনা কিছু প্রবীণ নিবাস থাকলেও এর সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বয়স্কদের চিকিৎসা ও দেখভালের জন্য সেভাবে বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানীতে সরকারি একটি প্রবীণ নিবাস থাকলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের প্রতিটি উপজেলায় প্রবীণ নিবাস হওয়া উচিত। একইসঙ্গে একজন প্রবীণ ব্যক্তি অবসরজীবন কীভাবে কাটাবেন, তার স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত হবে- এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। এই জনগোষ্ঠীর সেবা প্রদানের জন্য প্রশিক্ষিত জনবলেরও অভাব দূর করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ এস এম আতীকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিকে প্রবীণ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সমাজসেবা অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী বয়স্ক ভাতা পান প্রায় ৫৭ লাখের বেশি মানুষ। প্রতিমাসে একজন ব্যক্তিকে ৫০০ টাকা ভাতা দেওয়া হয়। আমাদের দেশে বার্ধক্যকে ব্যক্তি জানতে বা বুঝতে আগ্রহী নন। যখন কোনো দেশের জনসংখ্যার ১০ ভাগ মানুষ ৬০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের হয়ে যায় তখন সেই জনসংখ্যাকে প্রবীণ জনসংখ্যা বলা হয়। এবারের গৃহগণনায় ধারণার চেয়েও দ্রুত ৬০ বছরের অধিক জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, বার্ধক্য তিন ধরনের। ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সীরা ‘ইয়াং ওল্ড’। এরা আবারও কাজে ফিরতে চায়। ৭০ থেকে ৮০ বছর বয়সী ‘মিডেল্ড ওল্ড’। এদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। আর ৮০ বছরের ওপর যারা তারা ‘অতি প্রবীণ’। সারা পৃথিবীতে প্রবীণ জনসংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের কারণে এমনটি হচ্ছে। এখন সহজে মানুষ মারা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। মনে রাখার বিষয়, একটি দেশের যত উন্নয়ন হবে বার্ধক্য তত খারাপ অবস্থায় যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ গৃহগণনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে দেশে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে এই প্রবীণদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এই মানুষদের গুণগত জীবন নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু দেশে এই জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সব প্রবীণ পড়ছেন না। সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বয়স্করা যে ৫০০ টাকা ভাতা পাচ্ছেন- তাও অপর্যাপ্ত। আবার যে প্রবীণরা দরিদ্র, নিঃসন্তান তারাও সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি করতে হবে। দেশে প্রবীণ নারী ও পুরুষের মধ্যে বয়সের পার্থক্য আছে। এটি দূর করতে হবে। আবার বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তার আওতাধীন সুযোগ-সুবিধা পেতে যে প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করতে হবে। এজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট নীতিমালায় দেশের হাসপাতালগুলোতে জেরিএটট্রিক্স (বার্ধক্যবিদ্যা) থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে নেই। বয়স্করা যাতে সুলভে এই চিকিৎসা নিতে পারেন সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। একক পরিবারগুলোতে সন্তানদের মা-বাবার প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসহ অন্য সেবা নিশ্চিত করার ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। প্রবীণদের জন্য আন্তরিকতা বৃদ্ধিতে সামাজিকীকরণের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে।