নারী ডেস্ক: দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কম। এর মধ্যে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নতি, নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি, জন্মহার হ্রাস-এসব অগ্রগতি সত্ত্বেও শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ আনুপাতিক হারে বাড়েনি। বরং তা এক জায়গাতেই অনেক দিন স্থবির ছিল।
বাংলাদেশে ১৯৭০-এর দশকে জন্ম নেওয়া নারীদের ৩৬ শতাংশ এখন শ্রমশক্তিতে আছেন। ১৯৯০-এর দশকে জন্মগ্রহণ করা নারীদের ক্ষেত্রে তা আরও কম, মাত্র ১৩ শতাংশ। এর পেছনে সামাজিক রীতিনীতি ও মানদণ্ডের প্রভাব আছে। গত সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক সেমিনারে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হান্স টিমার এসব কথা বলেন।
হান্স টিমার বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়নের সঙ্গে এখানকার নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই অঞ্চলের নারীরা অর্থনৈতিক সুযোগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। তাঁরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছেন, আবার যোগাযোগ, সামাজিক যোগাযোগ, সম্পদের মালিকানা-এসব ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছেন।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টি মেলানো যায় না। হান্স টিমার বলেন, সমাজের গভীরে প্রোথিত রীতিনীতির কারণে নারীরা পিছিয়ে পড়ছেন, বিশেষ করে পরিবারের শ্রমের বিভাজন এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বিআইডিএসের মহাপরিচালক (ডিজি) বিনায়ক সেন জানালেন, মাঝে কিছুদিন শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার স্থবির ছিল। অতি সম্প্রতি দেখা গেছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ থেকে ৪২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার কম, এই বিষয়টি নিছক সামাজিক রীতিনীতির বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেন বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো কাজী ইকবাল। তিনি বলেন, অর্থনীতির কাঠামোগত কারণেও এমনটা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি গ্রামীণ অকৃষি খাতের কাঠামোর কথা উল্লেখ করেন। বলেন, দেশের গ্রামাঞ্চলে অকৃষি খাতের উন্নয়নের মূল জায়গা হচ্ছে যোগাযোগ। এ খাতে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ কম।
জবাবে হান্স টিমার বলেন, ‘পাকিস্তানে অনেক বড় বড় তৈরি পোশাক কারখানায় গিয়েছি। হাজার হাজার শ্রমিক সেখানে কাজ করে, কিন্তু একজন নারী শ্রমিকও দেখিনি।’ বিষয়টি মূলত সামাজিক রীতিনীতির, কাঠামোগত নয়, বলেন হান্স টিমার।
সবাইকে একই রকম কাজ করতে হবে বা একই রকম শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, তা ঠিক নয় বলে মনে করেন হান্স টিমার।
হান্স টিমার তাঁর উপস্থাপনায় আরও অনকে বিষয়ে আলোকপাত করেন। বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে বলেই যে ভবিষ্যতে তা বাজায় থাকবে বা অর্থনীতি বহুমুখী হবে, সেই নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। এখানে সবার জন্য সমান সুযোগ নেই বলে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতিতে বর্তমান সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণ হচ্ছে উৎপাদনশীল খাত অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়া। তবে সংকট থেকে নতুন সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয় বলে তিনি মনে করেন।
এই প্রসঙ্গে বিনায়ক সেন বলেন, দেশের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা উঠে আসছেন। তাতে একধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনও আসছে। গ্রামীণ অকৃষি খাতের বিকাশ হচ্ছে। তবে দেশে উচ্চশিক্ষার মান অনেকটাই পড়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন বিনায়ক সেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশের বেশি অনানুষ্ঠানিক। একই কথা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দক্ষিণ এশিয়ায় অনানুষ্ঠানিক খাত গত কয়েক বছরে ছোট তো হয়ইনি, বরং আরও বড় হয়েছে। এটাকে উন্নয়নের পথে বড় বাধা বলে মনে করেন হান্স টিমার।
হান্স টিমার জানান, তিনি পাকিস্তানে দেখেছেন যে অনেক প্রতিষ্ঠান অনানুষ্ঠানিক খাতেই থাকতে চায়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অনানুষ্ঠানিক থাকলে কিছু সুবিধা আছে, যেমন করের আওতার বাইরে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে দূরে থাকা যায়। এটা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় শক্তি, কারণ তাদের মূল শক্তি হচ্ছে সস্তা ও অদক্ষ শ্রম।
অবশ্য ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে দক্ষিণ এশিয়ার অনানুষ্ঠানিক খাতের অর্থনীতি বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন হান্স টিমার।
হান্স টিমার বলেন, গত তিন দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। দারিদ্র্য কমেছে। কিন্তু এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক উন্নতি হয়নি। তাঁর মতে, পৃথিবীর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় সুযোগের সমতা ও এক জীবনের মানুষের সামাজিক-শ্রেণিগত উন্নতি ও অবনতির প্রবণতা সবচেয়ে কম। অর্থাৎ বেশির ভাগ মানুষের অবস্থা জীবনভর একই রকম থাকে, ওঠানামা করে না।
জন্মস্থান, পারিবারিক পটভূমি, বর্ণ, জাতিসত্তা ও লিঙ্গ ইত্যাদি কারণে এ ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন অনেক সম্ভাবনাময় মানুষ। এতে সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্টের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হয়। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে যোগ্যদের সমান সুযোগ দিতে হবে বলে মত দেন হান্স টিমার।