বিজ্ঞান ডেস্ক: লন্ডনের ১৭ বছর বয়সী স্কুলপড়ুয়া রবিন ওয়েস্ট তার সহপাঠীদের চেয়ে একদিক দিয়ে আলাদা। আর সেটি হলো তার কোনো স্মার্টফোন নেই। অন্যদিকে, তার বেশিরভাগ বন্ধুর হাতে দামি দামি অ্যান্ড্রয়েড কিংবা আইফোন। সে টিকটক, ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রামের মতো অ্যাপ ব্যবহার করে না। তার একটা ফোন দরকার কেবল যোগাযোগ রক্ষার জন্য। সেজন্য একটা ফিচার ফোন ব্যবহার করে সে। ফলে স্মার্টফোনের অ্যাপের পেছনে যে সময় ব্যয় হয়, সেটি পড়াশোনা কিংবা পরিবার, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কাটাতে পারে।
রবিন এখানে একটি উদাহরণ মাত্র। মজার ব্যাপার হলো, ইউরোপ আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে হঠাৎ করে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই ফিচার ফোন। আমরা যাকে বলি ‘বাটন’ ফোন। স্মার্টফোনের সুযোগসুবিধা নেই বলে বাজারে এগুলো ‘ডাম্ব’ বা ‘বোবা ফোন’ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। একুশ শতকের শুরুর দিকে এই ফোনগুলো ছিল সবার ভরসা। বহুল জনপ্রিয় নকিয়া ব্র্যান্ডের বিভিন্ন মডেলের বাটন ফোনগুলো তখন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। সেই ফোনগুলোই আবার দেখা যাচ্ছে হাতে হাতে। কেবল পুরাতন প্রজন্ম নয়, নতুন প্রজন্মেরও হাতে হাতে দেখা যাচ্ছে এসব ফোন। তাদের চাহিদার দিকে নজর রেখে বিভিন্ন কোম্পানি তৈরি করছে বাহারি সব বাটন ফোন।
বাটন ফোনগুলো হলো মৌলিক হ্যান্ডসেট, যার কার্যকারিতা একটি স্মার্টফোনের তুলনায় খুবই সীমিত। আপনি শুধুমাত্র কল এবং এসএমএস করতে পারেন। বড়জোর একটু এফএম রেডিও শুনতে পারবেন, কম রেজুলেশনের ছবি তুলতে পারবেন কিংবা স্নেক এর মতো সেই প্রাগঐতিহাসিক যুগের দুই একটা গেম খেলতে পারবেন। কিন্তু এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অনেকে ফিরে যাচ্ছেন সেই ডাম্বফোনের যুগে।
লন্ডনের মিসেস ওয়েস্ট দুই বছর আগে তার স্মার্টফোনটি রেখে দিয়ে একটি ফিচার ফোন কিনেছেন। তার দাম ছিল মাত্র ৮ ব্রিটিশ পাউন্ড। এখনো তিনি সেটি ব্যবহার করছেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, আমি এই ফোনটি না কেনা পর্যন্ত লক্ষ্য করিনি যে, আগের স্মার্টফোনটি আমার জীবনে কতটা খবরদারি করছিল। মনে হচ্ছে ফোনটি আমার অধীন ছিল না, আমিই ছিলাম তার অধীন! আমার ফোনে অনেকগুলো সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ ইনস্টল করা ছিল এবং সেগুলোতে এতটাই বুঁদ হয়ে থাকতাম যে, কখন কোন অ্যাপে নোটিফিকেশন আসবে তার জন্য কান খাড়া করে রাখতাম। আপনজন, বন্ধুবান্ধব কিংবা অন্যান্য কাছের মানুষরা যেতে বললে বলতাম ‘ব্যস্ত আছি’। আমার কর্মক্ষেত্রের ক্লান্তি দূর করার জন্য যে বিশ্রামটুকু দরকার, আমার সন্তানদের কিংবা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যতটুকু সময় কাটানোর দরকার, গল্প গুজব করার দরকার, আমি সেগুলো না করে এসব অ্যাপে ব্যস্ত থাকতাম। দিন শেষে দেখতাম আমি অনেক কাজই ফেলে রেখেছি। তাড়াহুড়া করে সেগুলো করতে গিয়ে অনেক ভুল করতাম। সোশ্যাল মিডিয়াতে এতটা সময় কাটানো আমার স্বাস্থ্যের ওপর, ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলছিল। এখন বাটন ফোন ব্যবহার করছি, সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য। কম্পিউটারে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সারছি। এর পর দেখতে পাচ্ছি, আমার নিজের সংসারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য সময়ের অভাব নেই। স্মার্টফোনে সারাক্ষণ বুঁদ হয়ে যে ‘সামাজিক যোগাযোগ’ করতাম সেটি এখন না করে মোটেও খারাপ লাগে না। বরং ভালোই লাগে। অনেক ভারমুক্ত মানুষ মনে হয় নিজেকে।
এভাবে ফিচার ফোনগুলো ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। সফটওয়্যার সংস্থা ‘এসইমারশ’ এর একটি রিপোর্ট অনুসারে ২০১৮ সালের পর থেকে গুগলে ফিচার ফোনের ব্যাপারে সার্চ করার পরিমাণ প্রায় ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে ১০০ কোটির বেশি ফিচার ফোন বিক্রি হয়েছে। এর আগের বছর যে সংখ্যা ছিল ৬০ কোটি। এদিকে, অ্যাকাউন্টেন্সি গ্রুপ ডেলয়েটের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, যুক্তরাজ্যে বর্তমানে প্রতি ১০ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে একজনের হাতে দেখা যাচ্ছে একটি বাটন ফোন। বিষয়টি এমন না যে, তারা স্বল্প শিক্ষিত শ্রমিক কিংবা অসচ্ছল। ধনাঢ্য পরিবারের শিক্ষার্থী, অনেক উপার্জন করা চাকরিজীবী নারী, পুরুষ কিংবা ভিআইপিদের হাতে হাতেও দেখা যাচ্ছে এই ফোন। এমনকি ভারতেও ৪০ কোটির বেশি মানুষ ব্যবহার করছে এই ফোন। যুক্তরাষ্ট্রেও হু হু করে বাড়ছে এসব ফোনের বিক্রি। নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশও হাতে রাখছে কেবল একটি ফিচার ফোন। অনেকে মনে করছে, এটা তাদের আনস্মার্ট নয়, বরং আরও বেশি স্মার্ট করেই তুলছে। গবেষকরা বলছেন, স্মার্টফোন মানুষের বুদ্ধিদীপ্ততার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, নিজের মেধা ব্যবহারকে সীমিত করে ফেলছে, আর স্বাস্থ্যের ক্ষতি তো আছেই।
ব্রিটিশ মোবাইল বিশেষজ্ঞ আর্নেস্ট ডকু বলেন, মানুষের মন পরিবর্তনশীল। বাটনফোন থেকে যখন স্মার্টফোনের যুগ, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ শুরু হলো তখন মানুষের মনে হয়েছিল এটাই বুঝি জীবন। কিন্তু অনেকের কাছে এখন এসব ডিজিটাল যোগাযোগ কিংবা ডিজিটাল বিনোদন একঘেয়েমি হয়ে উঠেছে। তাই ফিরে যাচ্ছে ফিচার ফোনে। নিজেকে আরো বেশি করে সময় দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ নস্টালজিয়া থেকেও ফিরে যাচ্ছে এই ফোনে। তিনি বলেন, ২০২০ সালে নোকিয়া ৩৩১০ সেটটি পুনরায় বাজারে ছাড়ার পর সর্বাধিক বিক্রি হওয়া মোবাইল ফোনের তালিকায় স্থান পায়, যা সত্যিই নতুন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোন যত স্মার্ট হয়েছে মানুষের প্রাইভেসিও তত সংকটে পড়েছে। সময় নষ্ট কিংবা স্বাস্থ্যঝুঁকির বাইরে আপনি জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য কিংবা ছবি কত জায়গায় শেয়ার করেছেন তা হয়তো মনে করতে পারবেন না। এসব তথ্য কিংবা ছবি অপব্যবহারের সম্ভাবনাও কম নয়। এসব কারণেও অনেকে স্মার্টফোনকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে ফিরে যেতে চাইছেন সেই ‘বাপ-দাদার আমলে’!