প্রাতিষ্ঠানিক জাকাত বদলাতে পারে সমাজের চিত্র
সাদ্দাম হোসেন ইমরান: আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যবসার পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যক্তি উদ্যোগে জাকাত ফোরাম গঠন করা হয়েছে। শুরুটা হয় নিজ প্রতিষ্ঠান ও পারিবারিক জাকাত বণ্টনের মাধ্যমে। এতে সমাজ ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অভূত সাড়া পাওয়ায় সেটিকে বৃহদাকার রূপ দিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গঠন করেন সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেডএম)। এক সাক্ষাৎকারে সিজেডএম গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নিয়াজ রহিম। তিনি দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সুপারশপ ব্যবসার পথিকৃৎ রহিম আফরোজ গ্রুপের গ্রুপ পরিচালক।
সিজেডএমের যাত্রা
করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অংশ হিসাবে রহিমআফরোজ গ্রুপ পথচলার শুরু থেকেই মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন জনহিতকর কাজ করত। কিন্তু সেসব কার্যক্রম সমাজ উন্নয়নে, দারিদ্র্য বিমোচনে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে হলো। এরপর চিন্তা করলাম, মুসলমান হিসাবে আমরা তো জাকাত দিই। এই জাকাতটাই একটু সুশৃঙ্খলভাবে দেওয়া যায় কি না, সে লক্ষ্যেই পারিবারিকভাবে প্রথমে জাকাত ফোরাম গঠন করি। কোম্পানির সিএসআরের অর্থ ও পরিবারের সদস্যদের জাকাতের অর্থ ফান্ডে জমা দেওয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু।
প্রথমে আমরা মুন্সীগঞ্জের একটা গ্রামকে পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে বেছে নিই। সেখানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা ছিল না, মানুষজন তামাক চাষ করত, ঋণগ্রস্ত ছিল, শিক্ষাব্যবস্থাও নাজুক ছিল। আমরা সেখানে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি। ৩ বছর পর সেই গ্রামে আমূল পরিবর্তন আসে। সবাই স্যানিটেশন সুবিধা পেল, নিরক্ষরতার হারও কমে এলো। মাত্র ৬ লাখ বিনিয়োগ করে এত সাফল্য, আমাদের বুস্টার হিসাবে কাজ করল। এরপর জাকাত ফোরামকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে সিজেডএমের যাত্রা শুরু।
ব্যক্তিগত উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
জাকাত ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ। আল্লাহ্ তায়ালা ধনীর সম্পদের ওপর গরিবের হক প্রতিষ্ঠা করেছেন জাকাতের মাধ্যমে। এটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মূলত সরকার ও রাষ্ট্রের। আমাদের দেশেও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে জাকাত ফান্ড আছে। কিন্তু নানা জটিলতায় দারিদ্র্য নিরসনে জাকাত ফান্ড কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে হয়েছে। অন্যদিকে একান্ত ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় জাকাত দিয়ে সমাজের দারিদ্র্য নিরসন ও বঞ্চিত মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে বিশেষ কিছু করা যায় না বলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সিজেডএম গঠন করি। আমি মনে করি, কেবল প্রাতিষ্ঠানিক জাকাতই পারে সমাজের চিত্র বদলাতে। সব করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও বিত্তবান ইসলামের নিয়ম মেনে সঠিকভাবে জাকাত দিলে দেশে দারিদ্র্য বলতে কিছু থাকবে না।
জাকাত ব্যবস্থাপনা
সিজেডএমে প্রতিটি কাজের জন্য পৃথক কমিটি আছে। সহায়তার জন্য জমা পড়া সব আবেদন প্রাথমিকভাবে একটি দল যাচাই করে। সেই দল ব্যক্তির বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শর্ট লিস্ট করে। অন্য আরেকটি দল জাকাত গ্রহণে ইচ্ছুকদের আবেদনে উল্লিখিত তথ্য যাচাই করে। এরপর তাদের অনুকূলে অর্থছাড় করা হয়। অন্যদিকে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের অর্থ সিজেডএমে জাকাত হিসাবে দেন, তারাও খরচের হিসাব দেখতে পারেন। ইসলামের শরিয়াহ অনুযায়ী অর্থ খরচ করা হচ্ছে কি না, সেটা দেখভালের জন্য শরিয়াহ কমিটি আছে। এর বাইরে খরচের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ অডিট, বহিঃঅডিট এবং জাকাতদাতাদের খরচের হিসাব প্রতি প্রান্তিকে (তিন মান অন্তর) ই-মেইলে জানিয়ে দেওয়া হয়।
এখন সিজেডএম কী কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং সুবিধাভোগী কত?
৩০টির মতো করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ৩ হাজার ব্যক্তি সিজেডএমে তাদের জাকাতের অংশ দেন। প্রতি চান্দ্রবছর জাকাতের টাকা ইসলামের শরিয়াহ মোতাবেক ব্যয় করা হয়। সরকারি সহায়তা পেলে সিজেডএমকে আরও এগিয়ে নেওয়া যায়। জাকাত মানুষ দেয় শরিয়াহর বিধান মেনে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াবের আশায়। তারপরও সরকারি কিছু সহায়তা পেলে এই কার্যক্রমকে আরও বেগবান করা যেত। বর্তমানে আয়কর আইনে কয়েকটি সংস্থায় দানকে কর রেয়াতি সুবিধা দেওয়া আছে। যেমন, আহসানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল; এশিয়াটিক সোসাইটি; আইসিডিডিআর,বি; সিআরপি ইত্যাদি। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে দান করতে বেশি উৎসাহিত থাকে। কারণ কর রেয়াত পাওয়া যায়। সিজেডএমকে সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠানই তাদের জাকাতের টাকা দিতে এগিয়ে আসত। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আমরা একটি আবেদনও করেছিলাম।