মোস্তাক আহমাদ দীন
গজলকে একসময় বদলে দিয়েছিলেন পারস্যের বিখ্যাত কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ। গজল হয়ে উঠেছিল নানা প্রকার ফুলে গাঁথা একটি মালা। কীভাবে এসেছিল সেসব বদল? গজলের সুলুকসন্ধান।
শের মূলত দুই পঙক্তিতে রচিত হলেও তাকে শেষমেশ কবিতায় উত্তীর্ণ হতে হয়। সাধারণত ৫ থেকে ২৫টি-কিংবা তার বেশি শেরে লেখা হতে পারে একটি গজল। প্রতিটিই আলাদা, স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবু পরস্পরস্পর্শী। ‘গাইন’ ‘জাল’ ‘লাম’-আরবি ভাষার তিন হরফ দিয়ে ‘গজল’ শব্দটি গঠিত। উচ্চারণ ভেদে এই তিন হরফের তিনটি অর্থ: ‘গাজলুন’ সুতা; ‘গাজালুন’ সুতা কাটা, প্রেমালাপ; ‘গাজিলুন’ প্রেমালাপকারী-যে ব্যক্তি স্ত্রীলোকের পেছন পেছন ঘোরেন।
প্রথম অর্থটিকে আলংকারিকভাবে ধরে নিলে বলা যায় সনিষ্ঠ বয়ন; দ্বিতীয় ও তৃতীয় অর্থটি তো বহুল পরিচিত আর এই অর্থেই এর বিষয় হলো (অনু) রাগ, বেদনা, বিরহ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এমন আকুলতার প্রকাশ। আরেকটি মতে, গজলের মানে হরিণের আর্ত চোখ-এই অর্থ কিছুটা দূরবর্তী। এর উৎস খুঁজতে গেলে ‘জাল’ আর ‘লাম’ হরফের মাঝখানে আরেকটি দীর্ঘস্বর দ্যোতক ‘আলিফ’-এর হাজিরা মেনে নিতে হয়। তখন উচ্চারণ দাঁড়ায় ‘গাজাআ লুন’, যার অর্থ হরিণ (গাজাআ লাতুন হরিণী)। উর্দু কবি রঘুপতি সহায় ফিরাক গোরখপুরী গজলের একটি রূপকায়ত সংজ্ঞা দিয়েছেন, যা এ অর্থকে স্মরণ করিয়ে দেয়:
‘জঙ্গলে যখন শিকারি হরিণের পেছনে কুকুর লেলিয়ে দেয় আর হরিণ ছুটতে ছুটতে কোনো ঝোপে আটকে যায় যেখান থেকে তার বেরোনো অসম্ভব; সেই মুহূর্তে অসহায় পশুর কণ্ঠ চিরে এক বেদনাভরা আর্তস্বর বেরিয়ে আসে। এই করুণ স্বরের নামই গজল। বিবশতার দিব্যতম রূপ ভাবের করুণতম প্রকাশ ফুটিয়ে তোলাই গজলের আদর্শ।’
গজলের মধ্যকার ব্যথিত আকুলতার বিষয়টির কথা মনে রাখলে এই সংজ্ঞা গ্রহণযোগ্য।
এমন বিষয় ও আঙ্গিকের একটি গজল শুনে একদফায় তার ষোলো আনা রস ও মর্মের পরিচয় পাওয়া কঠিন। এতে দ্বন্দ্ব ও অসংগতি খুঁজে পেতে পারেন কেউ কেউ, বক্তব্য সংহত হয়ে উঠল কি না, সেই সওয়ালও উঠতে পারে, কিন্তু এর জওয়াবে বহুল প্রচলিত কথাটাই ফিরে আসে: গজল মূলত নানা প্রকার ফুলে গাঁথা একটি মালা। গজলের এই সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে মূলত হাফিজের গজলের মাধ্যমেই। অথচ হাফিজ-পূর্ববর্তী কবিদের মধ্যে শেখ সাদিসহ যাঁরাই যতগুলো শেরেই গজল লেখেন না কেন, তাতে প্রতিটি শেরের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র থাকত। কিন্তু খ্রিষ্টীয় চৌদ্দ শতকে পারস্যের তৎকালীন সিরাজনগরে জন্মগ্রহণকারী খাজা শামসুদ্দিন হাফিজের গজলের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের আঙ্গিকটি বদলে গেল।
বাহ্যত বিরোধী, মূলত আন্তঃস্পর্শী বিভিন্ন ভাবের শেরের সমন্বয়ে ঐকতান সৃষ্টি করে অভিনব নজির তৈরি করলেন হাফিজ। তাঁর বহুল আলোচিত একটি গজলের প্রথম পাঁচটি শের পড়ে নিলে এ কথার সত্যতা মিলবে। এটা সেই গজল, যেখানে সেই অপূর্ব সুন্দরীর কথা আছে, যার কালো তিলের জন্য হাফিজ তাকে বোখারা আর সমরকন্দ দান করে দিতে চেয়েছিলেন এবং তা পড়ে তৎকালীন ক্ষুব্ধ শাসক কবিকে দরবারে তলব করেছিলেন।
আগর আঁ তুরক্-ই-শিরাজি বদস্ত আরাদ দিল মা রা।
বখাল-ই-হিন্দুশ্ বখ্শম সমরকন্দ ও বোখারা রা।
বাদাহ্ সাকি ম্যায় বাকি কে দর্ জান্নাত না খাহি য়াফ্ত।
কানার-ই-আব-ই রুকনাবাদ ও গুলগশত-ই-মসল্লা রা ।
ফুগান কয়িনঁ লুলিয়ান-ই-শৌখ শিরিঁ
কার-ই-শ্যাহের-ই আশোব।
চুনাঁ বুরদন্দ্ সবর আয দিল কে তুরকাঁ
খোয়ান-ই-য়ঘ মা রা।
জে ইশক না তামাম মা জামাল-ই-য়ার মুসতঘ নিস্ত।
বা আব ও রংগ ও খাল ও খত চে হাজাত রুয়ে যেবা রা।
মন অয আঁ হুসন-এ-রোয অফযু কে ইউসুফ দাশ্ত দানস্তম
কে ইশক আয পর্দা-এ-অস্মত বরোঁ আর্দ জুলেখা রা।
গজলটি পড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বহুল প্রচারিত অনুবাদটির কথা মনে পড়বে, জনপ্রিয় সেই অনুবাদ সামনে থাকা সত্ত্বেও গজলের প্রতিষ্ঠিত আঙ্গিক স্পষ্ট করার জন্য নিজের অনুবাদে প্রথম পাঁচটি শেরের গদ্যভাষ্য এখানে পড়ে দেখা যেতে পারে।
প্রথম শের: গালে কালো তিলের অধিকারী শিরাজের সেই সুন্দরী যদি তার হৃদয় দান করে, তাহলে আমি তাকে বোখারা ও সমরকন্দ দিয়ে দেবো।
দ্বিতীয় শের: সাকি, তুমি আমাকে বেহেশতের শরাব দাও। কারণ, রুকনাবাদের এই নদী তীর, এই উদ্যান তুমি সেখানে খুঁজে পাবে না।
তৃতীয় শের: এই পাগল করা সুন্দরী আমাকে একদম বিধ্বস্ত ও শেষ করে ফেলেছে, যে রকম বিধ্বস্ত হয়েছে তুরস্কের ইয়াগমা নগর।
চতুর্থ শের: আমার জন্য প্রিয়তমার এই রূপই তো যথেষ্ট, আর এত অপরূপ সাজের কী প্রয়োজন!
পঞ্চম শের: দিনে দিনে যেভাবে ইউসুফের রূপ খুলছে, তাতে সে একদিন জুলেখার জীবন-যৌবন তো হরণ করবেই।
এই পাঁচ শেরই স্বয়ংসম্পূর্ণ। এদের মধ্যে আপাত কোনো সম্পর্ক নেই। গজলের সমগ্রতার মধ্যে এই যে আপাতদূরত্ব আর সম্পর্কহীনতা, তার ভেতরই গজলের সার্থকতা। আর এর মাধ্যমেই গড়ে ওঠে গজলের গজলত্ব, যাকে বলে ‘তাগাজ্জুল’।
একটি গজলের গজলত্ব যে কীভাবে সৃষ্টি হয়, তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে ব্যাখ্যা ও আলোচনায় তা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রী অভিনব গুপ্ত যে কাব্যের দুটি অর্থ ‘ব্যঞ্জনা’ ও ‘অভিধা’র মধ্যে ব্যঞ্জনাকে কাব্যের আত্মা বলে অভিহিত করেন, এই আত্মাকেই আমরা তাগাজ্জুল বলে ধরে নিতে পারি।
তবে ব্যঞ্জনাকে কাব্যের আত্মা বলে ধরা হলেও ‘অভিধা’র দিকে নজর কম দিলে চলে না, বরং অসচেতন হলেই কাব্যের লক্ষ্য দিশাহারা হতে বাধ্য। হাফিজের গজলের শেরগুলো তার আপাতদূরত্ব আর রহস্য সত্ত্বেও এতটা যে আকর্ষণীয়, তার কারণ তিনি এ বিষয়ে ছিলেন সম্পূর্ণ সজাগ। মনে হয় এই দূরত্বের রহস্য বা রহস্যের দূরত্বের কারণেই হাফিজকে অদৃশ্যর জিহ্বা (লিসানুল গায়ব) বা রহস্যের অনুবাদক (তরজমানুল আসরার) বলা হতো। পরবর্তীকালে হাফিজের গজলের সংকলনগুলো যে লোকপরম্পরায় আমাদের প্রচলিত খাবনামার/ফালনামার মতো একটি মুশকিল আসান কিতাবে পরিণত হয়েছে, তা হয়তো এই রহস্যের কারণেই। একালের লেখক-পর্যটক মঈনুস সুলতান এর একটি বর্ণনা দিয়েছেন কাবুলের ক্যারাভান সরাই বইয়ের ‘হাফিজ-এ-শিরাজির দেওয়ান’ শিরোনামের ভ্রমণগদ্যে।
তিনি এক জ্ঞানবৃদ্ধের কথা বলেছেন, যিনি হাফিজের একটি গজল সংকলন সামনে নিয়ে মানুষের মুশকিল আসানের পথ বাতলে দেন। লোকবিশ্বাস এই, যার যে আশাই থাকুক, সবকিছুর দিশা আছে এই গজলগ্রন্থেই। তাই লোকেরা তাঁদের জীবনসমস্যার সমাধান করার জন্য কাবুল, কান্দাহার, হিরাত ও পাগমান থেকে দানিশমন্দ আগা বা জ্ঞানবৃদ্ধের কাছে আসেন। প্রথমে সমস্যার কথা বলা হয়। পরে কোনো এক শিশুর মাধ্যমে কিতাবের পাতা ওল্টানো হয়। যে পৃষ্ঠায় হাত পড়ে, সে পৃষ্ঠার গজলটি পড়ে সেই আলোকে ব্যাখ্যা করে সমাধানের দিকনির্দেশনা দেন জ্ঞানবৃদ্ধ। একালের মঈনুস সুলতানের যে অভিজ্ঞতা, তার প্রায় আট দশক আগে পারস্য সফরে গিয়ে হাফিজের মাজারে তা-ই তো দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একজন ভেতরে গিয়ে বসলেন, সমাধিরক্ষক হাফিজের কাব্যগ্রন্থ নিয়ে এলেন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সাধারণের বিশ্বাস এই যে, কোনো একটি বিশেষ ইচ্ছা মনে নিয়ে চোখ বুজে এই গ্রন্থ খুলে যে কবিতা বেরোবে, তার থেকে ইচ্ছার সফলতা নির্ণয় হবে।’ মুশকিল আসানের জন্য যে কবিতা খোলা হলো, তার রূপকের কথা বাদ দিয়ে এর সরলার্থ ধরলে ‘সুন্দরী প্রেয়সীই কাব্যের উদ্দিষ্ট।’ কিন্তু এই কবিতা থেকে ‘বন্ধুরা প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরের সংগতি দেখে বিস্মিত হলেন।’ এ বিশ্বাস ছাড়া আর কী! রবীন্দ্রনাথও একে বলেছেন, ‘সাধারণ বিশ্বাস’, তা দিয়ে মুশকিল আসান হয় কি না, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু যেকোনো একটি গজলের মাধ্যমে যে জীবনসমস্যাকে আলোচনার বিষয় করে তোলা যায়, তার জন্য গজলে গূঢ়তর কিছু থাকতে হয়। একে তো ভিন্ন ভিন্ন শেরে তৈরি, তার ওপর বিষয়ও অনির্ধারিত। এ ছাড়া সেগুলো লিখিত হয়েছে প্রেমাস্পদের রূপে মুগ্ধ হয়ে। তবু যে এগুলো ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার সুযোগ করে দেয়, সেটাই হয়তো তাগাজ্জুল। এ জন্যই একটি গজল সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠেছে কি না, তা নিয়ে গজলের রচয়িতা উদ্বিগ্ন থাকেন। কারণ, গজল লেখার আগে তাঁকে অনেকটা নিবিড় কাঁটাতারের ফাঁকে পা ফেলে কসরত করতে হয়। এ জন্যই কখনো কখনো কবিরা বিষয়গত উল্লম্ফনের ঝুঁকি নিতে বাধ্য হন। গজলে দুটি পঙক্তিতেই একটি শের স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে এতে ছন্দ ও জটিল অন্ত্যমিলের মধ্য দিয়ে ধ্বনিব্যঞ্জনা রক্ষা করে কবিকে এগোতে হয়। সেই সঙ্গে হাজার বছর ধরে লেখা গজলের ঐতিহ্যের সাপেক্ষে নিজের অভিনবত্বকেও করতে হয় প্রতিষ্ঠা।
এত দিনে গজলে পরিবর্তন এসেছে, নানা রকম গ্রহণ-বর্জন চলেছে। পরে, আফগানিস্তান ও ইরানের নানা পর্বের গজলে সমাজ-রাজনীতির প্রসঙ্গ এসেছে প্রবলভাবে। আফগানিস্তানের রেজা মোহাম্মেদি কিংবা স্বামীর হাতে নিহত নাদিয়া আঞ্জুমানের কথা কে না জানে! নাদিয়া নিরেট প্রতিবাদী ছিলেন না, তাঁর গজলে এসে মিশেছিল হাফিজ ও রুমির ধ্রুপদি সংবেদনা। এমন পুনরাবর্তন ঘটেছে ইরানেও। ইসলামি বিপ্লবের আগের যুগে তাহের সফরজাদেহ্সহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ব কবির আবির্ভাব হয়, যাঁদের কবিতায় সমাজ-রাজনৈতিক প্রসঙ্গ তাৎপর্যপূর্ণভাবে যুক্ত হয়। বিপ্লব-পরবর্তী কবিতায় দেখা যায় আগের যুদ্ধপরিস্থিতি ও ধর্মানুষঙ্গ, বলা জরুরি, এই সময়কার উল্লেখযোগ্য কবিদের একজন আয়াতুল্লাহ খোমেনিও। এরপর একালের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরও এখনকার তরুণ কবিদের গজল আঙ্গিকের কবিতায় রাজনৈতিক বিষয় যুক্ত হলেও তবু প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ, প্রতীক-রূপকের ব্যবহারে তাঁরা এখনো ধ্রুপদি ধারার গজলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
আমির খসরুর হাতে শুরু হওয়া উর্দু গজলেও হয়েছে নানা পরিবর্তন, যা এখনো চলমান; কিন্তু সে আলোচনা আপাতত অপ্রাসঙ্গিক।