হযরত রাসুল (সা.)-এর দরবারে কবিতা পাঠ

হযরত রাসুল (সা.)-এর দরবারে কবিতা পাঠ

আতাউর রহমান খসরু
কবিতার প্রতি মহানবি (সা.)-এর অনুরাগ সুবিদিত। তিনি কবিদের প্রশংসা করতেন, তাদের জন্য দোয়া করতেন, অন্যের মুখ থেকে কবিতা আবৃত্তি শুনতেন। তবে তিনি কখনো মোটেই কবি ছিলেন না। কোনো নবির জন্য কবি হওয়া শোভনীয়ও নয়।

ভাষাগত দক্ষতা ও আবেগ থেকে তিনি কখনো কখনো ছন্দবদ্ধ বাক্য উচ্চারণ করেছেন। তবে এসব ছন্দবদ্ধ বাক্যকে কোনোভাবেই কবিতায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি রাসুলকে কাব্য রচনা করতে শেখাইনি এবং এটা তার পক্ষে শোভনীয় নয়। এটা তো শুধু এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কুরআন।’ (সূরা ইয়াসিন: আয়াত ৬৯)

কবি ও কবিতার প্রতি মনোভাব
হযরত রাসুল (সা.) কবি ও কবিতার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন। যা তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
১. কবিতা প্রজ্ঞাময়: রাসুলুল্লাহ (সা.) কবিতাকে জ্ঞানের বাহক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কোনো কোনো কবিতায় জ্ঞানের কথা আছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬১৪৫)
২. কবির জন্য দোয়া: হযরত রাসুল (সা.) বিভিন্ন সময় কবিদের জন্য দোয়া করেছেন। যেমন তিনি হাসসান বিন সাবিত (রা.)-এর উদ্দেশে বলেন, ‘হে হাসসান, তুমি আল্লাহর রাসুলের পক্ষ থেকে প্রত্যুত্তর দাও। হে আল্লাহ, আপনি জিবরাইল দ্বারা তাকে সাহায্য করুন। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬১৫২)
৩. ভালোর স্বীকৃতি: রাসুলুল্লাহ (সা.) কবিদের অর্থবহ ভালো কবিতার প্রংসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘কবিরা যেসব কথা বলেছেন, তার মধ্যে কবি লাবিদের কথাটাই সর্বাধিক সত্য। (সে বলেছে) শোন! আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই বাতিল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬১৪৭)
৪. কবিতায় আছে ভালো ও মন্দ: রাসুলুল্লাহ (সা.) কবিতা শুনতেন। তবে তিনি মনে করতেন, কবিতা বিচারযোগ্য। ভালো কবিতা যেমন প্রশংসনীয়, মন্দ কবিতা তেমন নিন্দনীয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কবিতা কথারই মতো। রুচিসম্মত কবিতা উত্তম কথাতুল্য এবং কুরুচিপূর্ণ কবিতা কুরুচিপূর্ণ কথাতুল্য।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ৮৭৩)

জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে না:
নবিজি (সা.) কবিতাকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পরিণত করার অনুমতি দেননি। বিশেষত যখন কাব্যচর্চা মানুষ মহান স্রষ্টা থেকে বিমুখ করে, স্বাভাবিক জীবনধারা থেকে বিচ্যূত করে এবং কবিতার বিষয়বস্তু অশ্লীল ও অশালীন হয়। তিনি সেদিকে ইঙ্গিত দিয়েই বলেন, ‘তোমাদের কারো পেট কবিতা দিয়ে ভরার চেয়ে পুঁজে ভরা অনেক ভালো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬১৫৪)
নবিজি (সা.)-এর দরবারে কবিতা আবৃত্তি: মহানবি (সা.)-এর মজলিসে কবিতা পাঠ করা হতো। আর কোনো বিরল বিষয় ছিল না। হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিরা মনমরা ছিলেন না। তারা তাদের বৈঠকগুলোতে উত্তম কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং জাহেলি যুগের বিষয়াদি আলোচনা করতেন। কিন্তু তাদের কাউকে আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধাচরণের উপক্রম দেখলে তাঁর (নবিজির) দৃষ্টি বিস্ফোরিত হয়ে যেত।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ৫৫৭)

নিজের প্রশংসার অনুমতি দেননি:
নবিজি (সা.) তাঁর দরবারে কবিতা আবৃতির অনুমতি দিয়েছেন। তিনি নিজের প্রশংসার অনুমতি দেননি। আসওয়াদ ইবনে সারি (রা.) বলেন, ‘আমি ছিলাম কবি। অতএব আমি নবি (সা.)-এর কাছে এসে বললাম, আমি যে কবিতার মাধ্যমে আমার প্রভুর প্রশংসা করেছি তা দ্বারা কি আপনার প্রশংসা করতে পারি না? তিনি বলেন, নিশ্চয়ই তোমার প্রভু প্রশংসা পছন্দ করেন। তিনি আমাকে এর অতিরিক্ত কিছু বলেননি।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ৮৬৯)

কখন কবিতা শুনতেন
হাদিসের বর্ণনানুসারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময় কবিতা শুনতেন। যেমন-
১. ঘরে স্ত্রীর মুখে: গবেষক ইয়াসিন খলিফা আত-তাইয়িব লেখেন, ‘আয়েশা (রা.)-এর ভাষাগত দক্ষতা নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। তিনি কবিতা মুখস্থ করতেন এবং তা বর্ণনা করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর কাছ থেকে কবিতা শুনে আনন্দিত হবেন এবং তাঁর মুখে বেশি বেশি কবিতা শুনতে চাইতেন।’ (ইজলাউল হাকিকাতি ফি সিরাতি আয়েশা সিদ্দিকা, পৃষ্ঠা ৬৩)
২. মসজিদে সাহাবিদের মুখে: জাবির বিন সামুরা (রা.) বলেন, ‘আমি শতাধিকবার নবি (সা.)-এর সঙ্গে মসজিদে সাক্ষাৎ করেছি। তাঁর সাহাবিরা কবিতা নিয়ে আলোচনা করতেন। জাহেলি যুগের কিছু বিষয় নিয়ে। কখনো কখনো তিনি তাদের সঙ্গে মুচকি হাসতেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৮৫০)
৩. সফরে সঙ্গীর মুখে: আমর বিন শারিদ (রা.) বলেন, একদিন আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাহনে সফরসঙ্গী হলাম। তিনি বললেন, তোমার স্মৃতিতে (কবি) উমাইয়া বিন আবিস সালতের কবিতার কোনো কিছু আছে কি? আমি বললাম, হ্যাঁ, তিনি বললেন, পড়ো। আমি তখন তাঁকে একটি লাইন আবৃতি করে শোনালাম। তিনি বললেন, বলতে থাকো, তখন আমি তাঁকে আরো একটি শ্লোক পাঠ করে শোনালাম। তিনি আবার বললেন, বলতে থাকো। শেষ অবধি আমি তাঁকে এক শ ছন্দ আবৃত্তি করে শোনালাম। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৭৭৮)
মসজিদে কবিতা পাঠের বিধান: উল্লিখিত একটি হাদিস দ্বারা বোঝা যায় মসজিদে কবিতা পাঠ করা বৈধ। কিন্তু বর্তমান সময়ে মানুষের যেহেতু আত্মনিয়ন্ত্রণ কম এবং মসজিদের শিষ্টাচার সম্পর্কে সতর্ক নয়, তাই ফকিহরা মসজিদে কবিতার আসর করতে নিষেধ করেন। তাদের প্রমাণ নিম্নোক্ত হাদিস-‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদের ভেতর কিসাস বাস্তবায়ন, কবিতা আবৃত্তি ও হদ কায়েম করতে নিষেধ করেছেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস: ৪৪৯০)

কবিতা শুনে প্রতিক্রিয়া
কবিতা শোনার পর নবিজি (সা.)-এর প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হতো। যেমন:
১. মুগ্ধ হতেন: নবিজি (সা.) কখনো কখনো কবিতা শুনে মুগ্ধ হতেন এবং আরো শুনতে চাইতেন। যেমন ওপরে আমর বিন শারিদ (রা.)-এর হাদিসে বলা হয়েছে।
২. মুচকি হাসতেন: কবিতা শুনে মুচকি হাসতেন। জাবির বিন সামুরা (রা.) বলেন, ‘আমি শতাধিকবার নবি (সা.)-এর সঙ্গে মসজিদে সাক্ষাৎ করেছি। তাঁর সাহাবিরা কবিতা নিয়ে আলোচনা করতেন। জাহেলি যুগের কিছু বিষয় নিয়ে। কখনো কখনো তিনি তাদের সঙ্গে মুচকি হাসতেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৮৫০)
৩. রাগ করতেন: কবিতা পাঠের সময় কেউ শরিয়তের সীমা লঙ্ঘন করলে নবিজি (সা.) প্রচন্ড রাগ করতেন। যেমন হাদিসে এসেছে, সাহাবিরা তাদের বৈঠকগুলোতে উত্তম কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং জাহেলি যুগের বিষয়াদি আলোচনা করতেন। কিন্তু তাদের কাউকে আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধাচরণের উপক্রম দেখলে নবিজি (সা.)-এর দৃষ্টি বিস্ফোরিত হয়ে যেত।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ৫৫৭)

৪. সংশোধন করে দিতেন: রুবাই বিনতে মুআব্বিজ (রা.) বলেন, আমার বিয়ের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার কাছে আসেন। তখন দুটি বালিকা গান গাচ্ছিল। তারা বদর যুদ্ধে নিহত আমার পিতৃপুরুষদের কীর্তিগাথা গাইছিল। তারা এটাও বলছিল, আমাদের মধ্যে এমন একজন নবি আছেন, যিনি আগামীকালের খবরও জানেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা এ কথা বোলো না। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৮৯৭)
আল্লাহ সবাইকে সুপথ দান করুন। আমিন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *