অর্থনৈতিক ডেস্ক: ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে বৈদেশিক ঋণের দায় বেড়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে নেওয়া স্বল্প সুদের ঋণ পরিশোধে এখন বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। প্রতি মাসে অন্তত ১০০ কোটি টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে। গত বছরের আগস্ট থেকে ডলারের ঊর্ধ্বগতি চলছে। ঐ সময়ে প্রতি ডলার ৮৪ দশমিক ৮৫ টাকা থাকলেও এখন গুনতে হচ্ছে প্রায় ১০০ টাকা। ফলে আগের নেওয়া ঋণের কিস্তি এবং সুদ পরিশোধে বাড়তি বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা যায়, গত (২০২১-২২) অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এই দুই মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের সুদ আর আসল মিলিয়ে ২৯ কোটি ৮২ লাখ ২০ হাজার ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। টাকার অঙ্কে ২ হাজার ৫৩০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই দুই মাসে সুদাসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ২৮ কোটি ৯৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার। টাকার অঙ্কে ২ হাজার ৭৩১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই দুই মাসে ডলারের হিসাবে ৮৪ লাখ ডলার কম পরিশোধ করা হলেও টাকার অঙ্কে বাড়তি পরিশোধ করতে হয়েছে ২০১ কোটি টাকা। গত বছরের ঋণ পরিশোধ করার সময় ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা ৮৫ পয়সা। আর এখন ডলার প্রতি খরচ করতে হয়েছে ৯৪ টাকা ২৮ পয়সা। তবে পরবর্তী সময়ে ডলারের দাম আরো বেড়েছে।
বর্তমানে বৈদেশিক ঋণে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চীন, ভারত, রাশিয়ার কাছ থেকেও বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। সাধারণত বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো আন্তর্জাতিক বহুপক্ষীয় উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে ঋণ পাওয়া যায় স্বল্প সুদে। এর হার দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ পর্যন্ত। তা পরিশোধ করতে হয় ৩০ থেকে ৪০ বছরে। আর কোনো দেশ থেকে নেওয়া ঋণের সুদহার শেষ পর্যন্ত সার্ভিস, ব্যবস্থাপনা চার্জসহ নানা শর্ত যুক্ত হয়ে তা দেড় থেকে আড়াই শতাংশে গিয়ে ঠেকছে। এর বাইরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নানা কঠিন শর্তও আছে। বড় সব প্রকল্পের ঠিকাদাররা বিদেশি। তাদের বেশির ভাগ পাওনা পরিশোধ করতে হয় ডলারে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ঠিকাদারের পাওনা পরিশোধেও বাড়তি অর্থ লাগছে। আবার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্প ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ভালো-মন্দ প্রভাব দুই দিকই রয়েছে। টাকায় ঋণ পরিশোধে চাপ এখন বেড়েছে। এজন্য বাজেটে খরচ বেড়ে যাবে। তবে নতুন যে বৈদেশিক সহায়তা আসবে সেগুলো ডলারের বর্তমান দরে হিসাব করা হবে। রাজস্ব আদায়েও এর প্রভাব রয়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। সার্বিকভাবে দেশের আমদানি কমে এলেও আমদানি বাবদ রাজস্ব আহরণ বেড়েছে। এনবিআরের হিসাবেও সেটি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বাজেট সাপোর্ট আকারে ঋণ দিতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বাজেটে চাপ কমে আসবে বলে তিনি মনে করে।
উল্লেখ্য, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬০০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্য ধরেছে ইআরডি। এর মধ্যে ১ হাজার ২৩৮ কোটি ২০ লাখ ডলার বৈদেশিক অর্থ ছাড়ের লক্ষ্য রয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সব মিলিয়ে ৯৩ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারের লক্ষ্য রয়েছে। বৈদেশিক ঋণের কিস্তি এবং সুদ বাবদ চলতি অর্থবছর ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
ঋণের পরিমাণ: বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে বর্তমানে ৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি ডলারের বেশি ঋণ পাইপলাইনে রয়েছে। ইআরডির হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে পাইপলাইনের আকার দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ৬ হাজার ১৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এর মধ্যে সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৮৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বহুপক্ষীয় সংস্থার ঋণের স্থিতি ৩ হাজার ১৯৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৭০২ কোটি ১০ লাখ ডলার। এর বাইরে সাপ¬ায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিট রয়েছে ১৮৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু এটি এখনো ঝুঁকিসীমার অনেক নিচে রয়েছে। আমাদের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখন ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় এটি ৪০ শতাংশের ওপরে উঠলে ঝুঁকি বিবেচনা করা হয়।