অলোক আচার্য
‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি দাঁড়িতে ঢাকবার জোটি নেই’- আমরা বাঙালি এবং আমরা যে যে ধর্মেরই হই না কেন আমাদের মূল পরিচয় বাঙালি এবং এই জায়গায় আমরা সকলেই এক এমন সত্য দৃঢ় উচ্চারণ যার কণ্ঠে ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে যোগদান করে সভাপতির বক্তব্যে ভারতীয় উপমহাদেশের এক অনন্য জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল।
এই উপমহাদেশে যেখানে মাঝে মধ্যেই জ্বলেছে বিভেদের আগুন, সেখানে হিন্দু বা মুসলিম এই পরিচয়ের চেয়ে আমরা যে বাঙালি এবং একই সুতায় গাঁথা সেই মহাসত্যই তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আমরা সবাই প্রথমে বাঙালি এবং এখানে কোনো ভিন্নতা নেই, কোনো মতভেদ নেই বা থাকার কথাও না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যখন রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় তখন তিনি বাংলার পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার এই অবস্থান বাঙালির ভাষা অধিকার প্রতষ্ঠার দাবিকে বলিষ্ঠ করে তুলেছিল। তিনি প্রকৃত অর্থে একজন পন্ডিত ছিলেন যার পান্ডিত্যের দ্যুতিতে আলোকিত হয়েছে গোটা উপমহাদেশ।
তার এই পান্ডিত্যের জন্য তাকে বলা হতো চলন্ত এনসাইক্লোপডিয়া। জ্ঞান অর্জন একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া এবং একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি তার জীবনকালের পুরোটা সময় জ্ঞান চর্চা করেন ও জ্ঞান বিতরণে নিরলস পরিশ্রম করে যান। পৃথিবীতে প্রকৃত জ্ঞানী বা জ্ঞানচর্চাকারী ব্যক্তির সংখ্যা খুব বেশি নয়। এর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হলেন- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। যিনি সত্যিকার অর্থে একজন জ্ঞানের বাতিঘর।
জ্ঞানসাধনা ছিল যার জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। শিক্ষা এবং শিক্ষকতা ছিল তার আজীবনের ব্রত। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক যিনি বহু ভাষা সম্পর্কে শিক্ষা নিয়েছেন এবং একজন দার্শনিক। লিখেছেন প্রচুর বই। শিক্ষক হিসেবে একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। বিবিসি বাংলার সর্বশে্রষ্ঠ বাঙালি জরিপে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তালিকার ১৬তম স্থানে আসেন।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুনশী মফিজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি হাড়োয়া গ্রামের গোরাচাঁদের প্রাচীন দরগাহর একজন খাদেম ছিলেন। তার মাতার নাম হুরুন্নেসা। শহীদুল্লাহ নামটি তার মা পছন্দ করে রেখেছিলেন। তার পড়ালেখা শুরু হয় তার গ্রামেই। গ্রামের পাঠশালাতেই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল। ছোটোবেলা থেকেই তার বিভিন্ন ভাষার প্রতি আগ্রহ ছিল। তার বই পড়ার প্রতিও আকর্ষণ ছিল। জানা যায়, তিনি স্কুল জীবনেই একাধিক ভাষা পড়তে শিখেছিলেন।
ভাষা শেখার প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল যা তাকে বহুভাষা শিখতে উৎসাহ দিয়েছিল। তিনি ১৮টি ভাষায় পন্ডিত ছিলেন (বাংলা, ফারসি, আরবি, উর্দু, ইংরেজি, অসমীয়া, ওড়িয়া, মৈথিলি, হিন্দি, পাঞ্জাবি, গুজরাতি, মারাঠি, কাশ্মীরি, নেপালি, সিংহলি, তিব্বতি, সিন্ধি, সংস্কৃত, পালি ইত্যাদি) এবং জানতেন প্রায় ২৪টি (কোনো আলোচনায় ৩০টি বা ২৭টির উল্লেখ আছে) ভাষা।
তার জীবনের শুরুই হয় শিক্ষকতা দিয়ে। তার জীবনে তিনি বহু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময়ে তিনি শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। তিনিই প্রমাণ করেন যে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে। বহু সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি ১৯১১ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠার সভাপতি ছিলেন। মাতৃভাষা বাংলার সপক্ষে তার জোরালো কণ্ঠ ছিল। তিনি দৃঢ় কন্ঠে বাংলাকে মাতৃভাষা করার পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রাইড অব পারফর্মেন্স লাভ করেন এবং ১৯৬৭ সালে ফরাসি সরকার তাকে নাইট অব দি অর্ডারস অব আর্টস এন্ড লেটারস পদক প্রদান করেন।
তিনি বলেন, যে দেশে গুণের সমাদর নেই সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না। আমাদের কথাবার্তায়, ভয়-ভালোবাসায়, চিন্তা ও কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাকে এমন চমৎকারভাবে উপস্থান করতে পেরেছিলেন তিনি ভাষাকে ভালোবাসতেন বলেই। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণ এবং বাঙালি চেতনা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাঙালি চেতনা যা বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে, অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বই লিখেছেন যা যুগ যুগ ধরে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি প্রবন্ধ, অনুবাদ, শিশুতোষগ্রন্থ রচনা করেছেন। তার সংকলন ও সম্পাদনায়ও বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, দীওয়ানে হাফিজ, রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম, নবী করিম মুহাম্মাদ, ইসলাম প্রসঙ্গ, বিদ্যাপতি শতক, বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খন্ড), বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, ব্যাকরণ পরিচয়, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, মহররম শরীফ, টেইল ফ্রম দি কুরআন, অমর কাব্য।
তার শিশুতোষ গ্রন্থগুলো হলো- শেষ নবীর সন্ধানে, ছোটদের রাসূলুল্লাহ এবং সেকালের রূপকথা। এই জুলাই মাসেই তার জন্ম ও মৃত্যু হয়েছে। এ উপমহাদেশ হারিয়েছে এক জ্ঞানতাপসকে। তার মতো জ্ঞানবান মানুষ পৃথিবীতে খুব কম জন্মগ্রহণ করে। এই মহান মানুষের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রইল।