আমাদের পরিচিত গ্রিন টি (সবুজ চা) ও আনফারমেন্টেড বা এটি গাঁজানো হয় না। প্রক্রিয়াজাতকরণের ভিন্নতার কারণে সবুজ চা দেখতে বিভিন্ন ধরনের, রঙের ও বিভিন্ন স্বাদ-গন্ধের হয়ে থাকে। চীনে তাজা পাতা গাছ থেকে সংগ্রহ করার পরপরই আগুনের উপর ঘূর্ণায়মান তামার পাত্রে শুকানো হয়। তারপর হাতে বা মেশিনে রোল বা পাকানো হয়, এর ফলে পাতাগুলো নির্দিষ্ট আকার ধারণ করে, কোনটা মোচড়ানো, আবার কোনটা বাঁকানো, কোনটা পাকানো। জাপানে একটু ভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। পাতাগুলোকে বােষ্পর মাধ্যমে নরম করে রোল করে শুকানো হয়। এই প্রক্রিয়া কয়েকবার করে করা হয়। সবশেষবার শুকানোর পর পাতাগুলোকে বিভিন্ন শে্রণিতে ভাগ করা হয়। জাপানে ‘মাচা’ নামে গুড়া এক ধরনের সবুজ চা তৈরি হয়। ‘চা-নো-ইউ’ নামের চা অনুষ্ঠানে এই চা ব্যবহার করা হয়। বােষ্প উত্তপ্ত ও গরম বাতাস দ্বারা শুকানোর পর চায়ের পাতাগুলো ছোট ছোট আকারে কাটা হয় এবং শুকিয়ে মিহি গুড়ো করে এই চা প্রস্তুত করা হয়।
কিছুটা গাঁজনকৃত চাকে ওলং চা বলা হয়, চায়নিজ ভাষায় ওলং শব্দের অর্থ কালো ড্রাগন। কিংবদন্তী অনুযায়ী, এক চা বাগানের মালিক চা পাতায় একটা কালো সাপ দেখে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর যখন তিনি ফিরে এলেন, দেখলেন, চাপাতাগুলো সূর্যের আলোতে গাঁজন হয়ে চমৎকার স্বাদের চা তৈরি করেছে। এই চায়ের পাতাগুলো পানিতে মেশানোর পর ছোট ছোট কালো ড্রাগনের মতো দেখা যায়, একারণে এই চায়ের এ রকম নাম হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। ঠিক কখন ওলং চা আবিস্কার হয়, সেটা জানা যায় না। এক ধারণা মতে, ষোড়শ শতাব্দীতে ফুজিয়ান প্রদেশের উই পাহাড়ে প্রথম ওলং চা আবিস্কৃত হয়, যেখানে এই চা এখনো খুব জনপি্রয়। অবশ্য, ১৮৮০ সালের পর থেকে তাইওয়ানেও বিশ্ববিখ্যাত কিছু ওলং চা উৎপাদিত হয়ে আসছে।
ওলং চা কচি পাতা অথবা বড় বয়স্ক পাতা, দুই ধরনের পাতা থেকেই উৎপাদন করা যায়। এই চা কিছুটা গাঁজনকৃত, অর্থাৎ গাঁজন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কিছু পরেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে সবুজ চায়ের মিষ্টি ঘ্রাণ ও কালো চায়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বাদের মিশ্রণ থাকে। ওলং চা দুই ধরনের হতে পারে, ফুলেল ঘ্রাণের সবুজ ওলং অথবা গাঢ় স্বাদের গাঢ় বাদামী পাতার ওলং। এই দুই ধরনের চা ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করা হয়।
চীনা প্রক্রিয়ায় হালকা স্বাদের ওলং চা প্রস্তুত করা হয়। চায়ের পাতা প্রথমে নেতানো হয়, একটা বড় কাপড়ের মধ্যে পুরে স্পেশাল মেশিনে রোল করা হয়। তারপর কাপড় মেলে চা পাতা অল্প সময় গাঁজনের সময় দেওয়া হয়। পাতাকে ক্রমাগত কাপড়ে মুড়ে রোল ও গাঁজানো হয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত ১৫-২০ ভাগ গাঁজন সম্পন্ন হয়। তারপর ৩% আদ্রতা পর্যন্ত শুকানো হয়। তাইওয়ানে তাজা চা পাতাকে নেতানো হয়, তারপর বাঁশের পাত্রে বা ঝাঁকানো যন্ত্রে নিয়ে ঝাঁকানো হয়। এর ফলে পাতা কিছুটা ছিন্নভিন্ন হয়। তারপর পাতা ৬০-৭০% গাঁজানো হয় এবং পরে শুকানো হয়।
অনেক ওলং চায়ের চমৎকার সব নাম রয়েছে, যেমন, সুই জিয়ান, যার অর্থ সাদা পরী, হুয়াং যিন গুই বা হলুদ সোনালী ফুল। সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপি্রয় ওলং চা হলো সুগন্ধী টাই গুয়ান ইন, করুণার দেবী গুয়ানইনের নামে এই চায়ের নাম দেওয়া হয়েছে, যেটা চীন ও তাইওয়ান, দুই দেশেই উৎপাদিত হয়। এই চাকে প্রায়ই গংফু স্টাইলে ছোট মাটির পাত্রে জ্বাল দেওয়া হয়, ছোট চায়ের কাপে পান করা হয়।
ব্ল্যাক টি বা কালো চা সম্পূর্ণভাবে গাঁজানো হয়। এটাকে কালো চা বলা হয় কারণ এই চা পাতার রঙ কালো রঙের হয়, চীনা ও জাপানীরা একে লাল চা বলে কারণ এর লিকারের রঙ লালচে। (বাংলা ভাষায়ও একে লাল চা নামে অভিহিত করা হয়)। মিং রাজবংশের শাসনামলে (১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রি.) এই চা প্রথম উৎপাদিত হয়। এসময়ের চা সাধারণত চায়ের খোলা পাতা পানিতে সিদ্ধ করে চা প্রস্তুত করা হতো। গাছ থেকে তোলার পর চায়ের পাতা বােষ্প সিদ্ধ করে শুকিয়ে রাখা হতো এবং ব্যবহার করা হতো। বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকৃত চা অবশ্য একসাথে জমাটবদ্ধ করে দূরবর্তী স্থানে পাঠানো হতো। এটা সাধারণ চা পাতার চেয়ে সহজে পরিবহন করা যেত ও দীর্ঘদিন ভাল থাকত কিন্তু দ্রম্নতই চায়ের স্বাদ-গন্ধ নষ্ট হয়ে যেত। পশ্চিমের সাথে বাণিজ্য বাড়ছিল এবং একইসাথে বাড়ছিল চায়ের চাহিদা। একটা পদ্ধতি আবিস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল যাতে চায়ের গুণাগুণ দীর্ঘ যাত্রায় ভালো থাকে। চা উৎপাদনকারীরা লক্ষ্য করলেন, চায়ের পাতাকে নেতানোর পর রোল করে ভেঙ্গে বাতাসে রেখে গাঢ় লাল হওয়া পর্যন্ত গাঁজালে এবং প্রাকৃতিক পঁচন প্রক্রিয়াকে আটকানোর জন্য শুকিয়ে রাখলে বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায়।
চীনে প্রধানত দুই ধরনের কালো চা রয়েছে, সাধারণ ও স্মোকি। সপ্তদশ শতকে চংগান প্রদেশে সর্বপ্রথম স্মোকি চা উদ্ভাবিত হয়। বলা হয়, স্মোকি চা দুর্ঘটনাক্রমে আবিষ্কৃত হয়েছে। এক বাগানে ফ্রেশ চা পাতা উত্তোলনের পর হঠাৎ একদল সেনা হাজির হয়। সেনাদের উপস্থিতির কারণে চা প্রক্রিয়াজাকরণ বিলম্বিত হয়। সেনাদল এলাকা ত্যাগ করার পর কর্মীরা বুঝতে পারে বাজারে চা পৌঁছানোর জন্য চায়ের পাতা শুকাতে সময় খুবই কম রয়েছে। তাই তারা শুকানো প্রক্রিয়া তরান্বিত করার জন্য পাইন গাছের কাঠ পুড়িয়ে তাপ দিতে শুরু করে। আবিষ্কার হয় স্মোকি চা।
কালো চায়ের প্রধান উৎপাদক ভারত। ভারতে নানা স্বাদ-গন্ধের চা উৎপাদিত হয়। কোমল স্বাদের দার্জিলিং চা থেকে শুরু করে কড়া স্বাদের আসাম চা, ভারতে রয়েছে নানা স্বাদের চায়ের উপস্থিতি। শ্রীলংকায়ও নানা ধরনের কালো চা উৎপাদন হয়। এসবের বেশিরভাগই ব্লেন্ডিং বা চা মিশ্রণ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, যেমনটা হয় বিভিন্ন আফ্রিকান ও দক্ষিণ আমেরিকান চায়ের ক্ষেত্রেও। চা উৎপাদনে আফ্রিকা চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
(চলবে)
[হেলেন সাবেরির ‘Tea, A Global History’ থেকে অনূদিত, অনুবাদ: সালাহ উদ্দিন]