বাণিজ্য ডেস্ক: দেশে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বন্যার জলের মত হু হু করে বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি-উভয় খাতের বিদেশি ঋণেই রয়েছে উর্ধগতি। গত ৭ বছরে মোট বিদেশী ঋণের পরিমাণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শাসনামলের সর্বশেষ ১৪ বছরে এই ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে তিনগুণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছর (২০২২-২৩) শেষে দেশের মোট বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৯ বিলিয়ন ডলার (৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন)। এর মধ্যে অর্থবছরের শেষ তিন মাসে (এপ্রিল ২৩-জুন ২৩) মাসে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ বেড়েছে।
এ হারে ঋণ গ্রহণ চলতে থাকলে চলতি বছর (২০২৩) শেষে ঋণের পরিমাণ ১০৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বিদেশী ঋণ বাড়তে থাকায় অর্থনীতিতে এই ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়ছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে কঠিন শর্তের ঋণ বাড়িয়েছে দুশ্চিন্তা।
আগামী চার মাসের মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধের চাপ রয়েছে। এর মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে সরকারকে। আর বাকী ৯ বিলিয়ন ডলার বেসরকারি খাতকে পরিশোধ করতে হবে। দেশে ডলার সঙ্কটের মুখে বেসরকারি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান বিদেশী ঋণ পরিশোধ কয়েক দফায় বিলম্বিত করেছে। তাই চাইলেও এই নয় বিলিয়ন ডলারের কিস্তি বিলম্বিত করা বেশ কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান দুটি উৎসের মধ্যে রেমিট্যান্সের অবস্থা খুবই নাজুক। টানা কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। এর মধ্যে চলতি সেপ্টেম্বর মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারা উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ মাসের প্রথম ২২ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। গড়ে দিনে ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। বাকী দিনগুলোতে একই হারে রেমিট্যান্স এলে মাস শেষে এর পরিমাণ দাঁড়াবে মাত্র ১৪৩ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। এটি গত আগস্ট মাসের চেয়েও ১২% কম।
গত আগস্ট মাসে দেশে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। যা ছিল আগের ৬ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ। অন্যদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ২০৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকেই দেশে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দ্রæত গতিতে বাড়ছে। এর মধ্যে গত ৭ বছরে ঋণের প্রবৃদ্ধির হার আগের ৭ বছরের প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। পরের অর্থবছর (২০১৭-১৮) তা ১০ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ৫৬ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৬২ বিলিয়ন বেড়ে ৬২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন বেড়ে ৬৮ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন, ২০২০-২১ অর্থবছর ১২ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন বেড়ে ৮১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন বেড়ে ৯৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাত্র ৩ দশমিক ৭১ বিলিয়ন বেড়ে ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন দাঁড়ায়।
বিদেশী ঋণ বৃদ্ধির বিপরীতে অন্যান্য খাত থেকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসার পরিমাণ বাড়েনি। কিন্তু ঋণ পরিশোধ বেড়েছে। কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। এতে দ্রæত কমে আসছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। শুধু গত ৭ দিনেই রিজার্ভ কমেছে ৩০ কোটি ডলার। রিজার্ভ নেমে এসেছে ২১ বিলিয়ন ডলারের নিচে। বাণিজ্য ঘাটতি, রেমিট্যান্সে ঋণাত্মক ধারা, রিজার্ভ কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে আশংকা দেখা দিয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি বাংলাদেশের মানের অবনমন ঘটিয়েছে। সব মিলিয়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে।