২০২৩ সালে গ্লোবাল সাউথের উত্থান

২০২৩ সালে গ্লোবাল সাউথের উত্থান

জাতিসংঘের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে কূটনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারক-সবাইকে এ বছর গ্লোবাল সাউথ নিয়ে বেশ ব্যস্ত মনে হয়েছে। গত বছর ‘জি-২০’-এর ভার্চুয়াল সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতকে ‘গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বর’ বলে অভিহিত করেছেন। এরপর সেপ্টেম্বরে ভিয়েতনামে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার বক্তৃতায় গ্লোবাল সাউথকে তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে সম্বোধন করেন।
গবেষকদের মতে, গ্লোবাল সাউথের নতুন রাজনীতি ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উচ্ছ্বসিত দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধটা এখানে একটা উপযুক্ত উদাহরণ হতে পারে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশ মস্কোর সমালোচনা করা এড়িয়ে গেছে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের নিন্দা করার জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাব থেকেও তারা বিরত ছিল। এমনকি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ান তেল ও গ্যাস আমদানি করেছে গ্লোবাল সাউথের বেশ কয়েকটা দেশ।
২০২২-এর সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার পূর্ণ আক্রমণ শুরু হওয়ার প্রায় ১৮ মাস পর ইউক্রেনের পক্ষে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সমর্থন জোরদার করার জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগদান করেন। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক ‘ফরেন পলিসি’র হাওয়ার্ড ডব্লিউ ফ্রেঞ্চ বলেছিলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোর এমন আচরণের মাধ্যমে তারা একটা স্পষ্ট বার্তা প্রদান করে। দরিদ্র দেশগুলো উন্নত বিশ্বকে যেন বলতে চায়, আপনাদের কাছে আমাদের সমস্যাগুলো যত দিন না অর্থ বহন করবে, তত দিন আমরাও আপনাদের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না।’
গত বছরের দুটো গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন বিশ্ব রাজনীতিতে গ্লোবাল সাউথের উত্থানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। একটা আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন এবং অন্যটা সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে আয়োজিত ‘জি-২০’ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন। জোহানেসবার্গের সম্মেলনে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্লক ব্রিকস ঘোষণা করেছে যে তারা তাদের ব্লকে ছয়টা নতুন সদস্য যুক্ত করবে। ব্রিকসের সম্প্রসারণ তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারবে কি না, তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়, তবে তাদের সিদ্ধান্ত ‘ডি-ডলারাইজেশন’ প্রক্রিয়ার আলোচনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ রূপ প্রদান করেছে।
ইতিমধ্যে নরেন্দ্র মোদি ‘জি-২০’ শীর্ষ সম্মেলনে তাদের এজেন্ডা সম্প্রসারণ করে গ্লোবাল সাউথের প্রধান সমস্যাগুলো যেমন-আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিবাসন সমস্যার সমাধানে উন্নত বিশ্বকে এগিয়ে আসার আহ্বান করেন। বিশ্বব্যাংকের তহবিল বৃদ্ধির লক্ষ্যে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে তাদের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উত্তেজনা ও অনৈক্য বিরাজমান ছিল, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। যদিও অক্টোবরে গাজায় শুরু হওয়া যুদ্ধটা তাদের মধ্যে পুনরায় মতানৈক্য তৈরি করে। কারণ গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো হামাস ও ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমা সমর্থনকে ভন্ডামি বলে অভিহিত করে।
গ্লোবাল সাউথ এখন পুরো বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতিতে তাদের প্রভাব ক্রমশই শক্তিশালী করে তুলছে। এমনকি অনেক বিশ্লেষক ধারণা করছেন, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক রাজনীতি ও কূটনীতির কেন্দ্রে অবস্থান করবে গ্লোবাল সাউথ।
বিশ্ব রাজনীতিতে গ্লোবাল সাউথের প্রভাব সম্পর্কে ফরেন পলিসি কর্তৃক প্রকাশিত কয়েকটা শীর্ষ নিবন্ধের বিশ্লেষণাত্মক পর্যালোচনা নিম্নে তুলে ধরা হলো-
বিশ্ব এখনো পশ্চিমের হাতেই রয়েছে
ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ আগ্রাসন শুরু করার এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার এতগুলো দেশ কেন কিয়েভের প্রতি সমর্থন প্রদর্শন করছে না? এ ব্যাপারে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও কমফোর্ট ইরো মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ না করলে তারাও পশ্চিমের সমর্থনে এগিয়ে আসবে না। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে পশ্চিমা দেশগুলো সর্বদা উন্নয়নশীল দেশগুলোর আনুগত্য আশা করে। কিন্তু এখানে পশ্চিমা বিশ্বকে বুঝতে হবে, আনুগত্য লাভের জন্য তাদের সমস্যাগুলোকেও প্রাধান্য দিতে হবে। তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে বিশ্ব এখনো পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণাধীনই রয়েছে।
‘সুইং স্টেটস’ ভূরাজনীতির ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে
ইউরেশিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান ক্লিফ কুপচান বলিয়াছেন, সুইং স্টেটস অর্থাৎ ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুর্কিসহ গ্লোবাল সাউথের অন্যান্য দেশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এই ছয়টি সুইং রাষ্ট্র ইতিমধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা পরিকল্পনা অনুযায়ী কিয়েভকে সামরিক সহায়তা প্রদানে অস্বীকার করেছে। পশ্চিমা মতের বিরুদ্ধে গিয়ে রাশিয়াকে সমর্থন প্রদানের অর্থ হলো ভূরাজনীতিতে পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি এখন গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
‘জি-২০’ কি গ্লোবাল সাউথের চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে?
‘গ্রুপ অব ২০’, অর্থাৎ ‘জি-২০’ ব্লকে গ্লোবাল সাউথের অনেকগুলো দেশ রয়েছে। তবে উক্ত ব্লকের ধনী সদস্যরা দীর্ঘকাল ধরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে আসছে। গত সেপ্টেম্বরে ভারত যখন বার্ষিক ‘জি-২০’ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, তখন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড্যারেন ওয়াকার যুক্তি দিয়েছিলেন, এখন ‘বিশ্ব রাজনীতিতে গ্লোবাল সাউথ প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি বিশ্বে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের একটা অভূতপূর্ব যুগের সূচনা করতে যাচ্ছে।’
ওয়াকার বলেন, ভারত তার ‘জি-২০’ প্রেসিডেন্সিতে এমন সমস্যাগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, যা গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোকে অসমভাবে প্রভাবিত করত। উন্নত বিশ্বের সমস্যাগুলোর চেয়ে উন্নয়নশীল দেশের সমস্যাকে অধিক প্রাধান্য দেওয়ার এই বিষয়কে তিনি গ্লোবাল সাউথের উত্থানের শুরু হিসেবে বিবেচনা করছেন।
গ্লোবাল সাউথ বলতে কি আদৌ কিছু আছে?
বর্তমানে ‘গ্লোবাল সাউথ’ শব্দটা বিশ্ব রাজনীতির মূলধারায় উঠে এসেছে। ‘ফরেন পলিসি’র রাজা মোহন বলেন, জলবায়ু নীতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এক কাতারে ফেলে সবাইকে গ্লোবাল সাউথ বলে অভিহিত করার সুবিধা হচ্ছে সবার সমস্যাগুলো এখন একসঙ্গে আলোচনা করা যায়। কিন্তু রাজা মোহন এখানে প্রশ্ন তোলেন, ‘গ্লোবাল সাউথ বলতে কি আদৌ কিছু আছে?’
তিনি এই ধারণার সঙ্গে বেশ কিছু বিশ্লেষণাত্মক ত্রুটি তুলে ধরেন, যেটাকে তিনি ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং উন্নয়নের পথ রয়েছে। তাদের সব সমস্যা এক রকম নয় এবং সমস্যার সমাধানও একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। মোহন মনে করেন, এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে সব উন্নয়নশীল দেশকে এক কাতারে ফেলা উচিত নয়।
মোহন মনে করেন, গ্লোবাল সাউথ ক্যাটাগরিটা শীঘ্রই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শব্দভান্ডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে-এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। তার মতে, পশ্চিমা বিশ্ব উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পশ্চিম থেকে আলাদা করে উল্লেখ করার জন্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই নামে অভিহিত করে।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক ‘ফরেন পলিসি’র জ্যেষ্ঠ সম্পাদক
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আল মামুন

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *