হজের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য – মুহাম্মদ জহিরুল আলম

হজের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য – মুহাম্মদ জহিরুল আলম

মহান আল্লাহ্ নিজের পরিচয় প্রকাশের লক্ষ্যে যুগে যুগে অসংখ্য মহামানব প্রেরণ করে আসছেন। তাঁরা সমকালীন যুগের মানুষের মাঝে প্রভুর পরিচয় তুলে ধরে, আত্মশুদ্ধির শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে মানুষকে প্রভুর সান্নিধ্য পাইয়ে দেন। যাঁরা এই শিক্ষা প্রদান করেছেন নবুয়তের যুগে তাঁদেরকে বলা হতো ‘নবি-রাসুল’। নবুয়তের যুগে তাঁরা পথপ্রদর্শক হিসেবে তাঁদের সময়ের মানুষকে আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগের শিক্ষা দিয়েছিলেন। বেলায়েতের যুগে যাঁরা মোর্শেদ হিসেবে আসবেন তাঁদেরকেই ‘অলী-আল্লাহ্’ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “আর আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের মধ্যে এমন একদল আছে, যারা সত্য পথ দেখায় এবং সেই অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে।” (সূরা আ’রাফ ৭: আয়াত ১৮১) মানব মুক্তির বিধান মহামানবগণই দান করেছেন। ইসলামের প্রতিটি বিধান মূলত মহামানবগণের অনুকরণ ও অনুসরণ। তাই ধর্মের মূল শিক্ষাই হলো মহামানবগণের আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করা।


হজ মুসলমানগণের পবিত্র ধর্মীয় বিধান। এর ভিত্তি আল্লাহ্র মনোনীত মহামানবগণের স্মৃতিকে স্মরণ ও অনুসরণ করা। হজ শব্দটির আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা, ইচ্ছা করা। “শরিয়তের পরিভাষায় হজের সংজ্ঞা হলো- আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে শরিয়তের নিয়ম অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থান অর্থাৎ কাবাঘর জিয়ারত, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান ইত্যাদি কার্যাদি সম্পন্ন করে মোহাম্মদী ইসলামের বিধান অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করার সংকল্প করাকে হজ বলা হয়।” (মোহাম্মদী ইসলামের তালিম, পৃষ্ঠা ১৭১) এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মাঝে পঞ্চম। কেবলমাত্র ধনীদের উপর হজ ফরজ। কারণ ধনীরা সাধারণত ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “মানুষের মধ্যে তার উপর আল্লাহ্র জন্য এ ঘরে হজ করা ফরজ, যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৯৭) হযরত রাসুল (সা.)-এর মদীনায় হিজরতের পর দয়াল রাসুল (সা.)-এর আগ্রহে মহান আল্লাহ্র নির্দেশে মাসজিদুল হারাম কেব্লা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। হাজিগণ মদীনায় গিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা শরীফ জিয়ারত করেন। এতে অন্তরে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেম জাগ্রত হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আমার ওফাতের পর যে ব্যক্তি হজ সম্পাদন করে আমার রওজা জিয়ারত করবে, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল।” (ইমাম বায়হাকীর সুনানে কুবরা ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৩)


হজের প্রতিটি কার্য কোনো না কোনো মহামানবের স্মৃতি বিজড়িত। হজের ফরজ ৩টি যথা- ১. ইহরাম বাঁধা, ২. কাবা শরীফ তাওয়াফ করা এবং ৩. আরাফাতের ময়দানে সমবেত হওয়া। এছাড়া মিনায় কঙ্কর নিক্ষেপ, সাফা মারওয়ায় দৌড়ানো, পশু কোরবানি, হাজরে আসওয়াদ পাথরে চুমু খাওয়া প্রতিটি ক্ষেত্রে মহামানবগণের স্মৃতিকে স্মরণ ও তাঁদের অনুসরণ করা হয়। ইহরাম বাঁধার মাধ্যমে নিজেকে মৃতবৎ খেয়াল করার একটা অনুশীলন হয়। তখন সেলাইবিহীন দুই খণ্ড সাদা কাপড় পরিধান করে খালি মাথা ও খালি পা হয়ে সকল প্রকার কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করে আল্লাহ্র ধ্যানে মগ্ন থাকতে হয়। হযরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘর নির্মাণ করে নিজে সেখানে অবস্থান করতেন। তাঁর প্রতি আনুগত্য করে তাঁর অনুসারীরা কাবাঘর তাওয়াফ করতেন এবং তাদের মানত আদায় করতেন। এ ধারাবাহিকতায় আজও হাজিগণ হজ করতে গিয়ে কাবাঘর ৭ বার তাওয়াফ করেন। হযরত আদম (আ.) আরাফাতের ময়দানেই হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর উসিলায় গুনাহ মাফের সুসংবাদ প্রাপ্ত হন এবং বিবি হাওয়ার সাক্ষাত পান। হাজিগণ আরাফাতের ময়দানে গিয়ে এ স্মৃতির কথা স্মরণ করে নিজেদের জীবনের কৃত গুনাহের জন্য আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। দয়াল রাসুল (সা.) ১০ম হিজরিতে প্রায় সোয়া লক্ষ সাহাবি নিয়ে হজ পালন করেন। ঐ সময় তিনি আরাফাতের ময়দানে সবাইকে একত্র করে যে বাণী মোবারক প্রদান করেন তাই পবিত্র বিদায় হজের ভাষণ নামে পরিচিত। আমরা জানি কোরবানি সুন্নতে ইব্রাহিম। যেহেতু দয়াল রাসুল (সা.) কোরবানি করেছেন, হাজিগণ তাই মিনায় গিয়ে কোরবানি করেন। বিবি হাজেরা ও শিশু হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর অনুসরণে হাজিগণ, হজের আহকাম হিসেবে সাফা মারওয়া পর্বত সায়ি করেন। শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ করার মাধ্যমে হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর স্মৃতি স্মরণ ও আনুগত্য প্রকাশ করেন। এ কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ.) শয়তানের উদ্দেশে। কোরবানি হওয়ার জন্যে যখন তিনি পিতার সাথে মিনার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন শয়তান তাঁকে কুমন্ত্রণা দিয়েছিল। পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে এ কথা জানালে পিতা তাঁকে পরামর্শ দিলেন, শয়তানের প্রতি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে। পবিত্র হজ মহান স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পণের এ মহান স্মৃতি আমাদের বারবার স্মরণ করে দেয়।


হযরত ইব্রাহিম (আ.) মক্কার মরুভূমিতে নির্বাসিত বিবি হাজেরা (আ.) ও শিশু পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে দেখতে যান। ঘটনাক্রমে তিনি উটের পিঠ থেকে জমিনে নামতে না চাইলে বিবি হাজেরা (আ.) একখানা কৃষ্ণবর্ণের পাথরের উপর হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে নামতে অনুরোধ করলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) সেই পাথরের উপর অবতরণ করেন। বিবি হাজেরা (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.) অত্যন্ত আদব, ভক্তি ও মহব্বতের সাথে আল্লাহ্র নবি হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পদ চুম্বন করলেন, তাঁর পা মোবারক জমজম কূপের পানি দিয়ে ধুইয়ে দিলেন এবং বিবি হাজেরা (আ.) নিজের মাথার চুল দিয়ে আল্লাহ্র বন্ধুর পা মোবারক মুছে দিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) সেখান হতে বিদায় নিয়ে চলে আসার পর তাঁরা পাথরটিকে যতেœর সাথে উঁচু স্থানে নিয়ে রাখেন। যখনই আল্লাহ্র নবি হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কথা স্মরণ হতো তাঁরা ঐ পাথরে চুমু খেতেন। আজও হাজিগণ গুনাহ মাফের আশায় বায়তুল্লাহ শরীফে রক্ষিত ‘হাজরে আসওয়াদ’ পাথরে চুমু খেয়ে থাকেন। মহান আল্লাহ্ মুসলমানদের নামাজের স্থান নির্ধারণ করেছেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কদম মোবারকের স্পর্শকৃত মাকামে ইব্রাহিমকে। মহান আল্লাহ্ বলেন, “তোমরা মাকামে ইব্রাহিমকে নামাজের স্থানরূপে গ্রহণ করো।” (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ১২৫) হজের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন, “(হে ইব্রাহিম!) মানুষের নিকট হজের ঘোষণা করে দাও- তারা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে এবং সর্বপ্রকার দুর্বল উটের পিঠে, উহারা আসবে দূর দূরান্তের পথ অতিক্রম করে, যাতে তারা উপস্থিত হতে পারে তাদের কল্যাণময় স্থানসমূহে।” (সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ২৭-২৮) মহামানবের স্মৃতির সাথে জড়িত বলে হজ পালনকালে যতগুলো কার্য সম্পাদন করা হয় সবগুলোই পবিত্র।


যুগে যুগে মহামানবগণের শিক্ষা ও আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করাই ছিল সমকালীন মানুষের ধর্ম। এর ভিন্নতা করে আমরা যা কিছুই করি না কেন, সবই ধর্মের নামে আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। মহামানবকে ছেড়ে দিয়ে ধর্ম পালন মূল্যহীন। মহান আল্লাহ্ জগদ্বাসীর নিকট তাঁর পরিচয় তুলে ধরার জন্য যুগে যুগে যত নবি-রাসুল, অলী-আল্লাহ্ প্রেরণ করেছেন, তাদের মতাদর্শই ইসলাম। যারা ঐ সকল মহামানবগণের শিক্ষা ও আদর্শ মেনে সেই মোতাবেক জীবন পরিচালনা করেছেন তারাই আল্লাহ্র খাঁটি বান্দা, আর যারা মহামানবগণের শিক্ষা ও আদর্শকে অস্বীকার করেছে তারাই কাফের বলে অভিশপ্ত হয়েছে। মহামানবগণকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্যে হজ পালন মূল্যহীন। যারা আল্লাহর বন্ধুদের শিক্ষা ও আদর্শ হতে দূরে থাকে এবং তাঁদের কুৎসা রটনা করে তাদের হজ যে সঠিক হচ্ছে না তা জ্ঞানী মাত্রই বুঝতে পারেন। আল্লাহর মনোনীত মহামানবগণের বিরোধিতা করে, তাঁদের কষ্ট দিয়ে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা অর্থহীন। মহামানগণের সুউচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে হযরত ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, “আমি নবি (সা.)-কে কাবা শরীফ তাওয়াফ করতে দেখলাম। তখন তিনি বলছিলেন- (হে কাবা!) তুমি কত পবিত্র এবং কতই না পবিত্র তোমার ঘ্রাণ! কতই না বড়ো মর্যাদাসম্পন্ন তুমি এবং তোমার সম্মান কতইনা উচ্চ! যাঁর হাতে মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণ নিবন্ধ, তাঁর শপথ করে বলছি- আল্লাহ্র নিকট মু’মিনের মর্যাদা তোমার মর্যাদার চেয়েও অনেক বেশি। তাঁর জানমাল এবং তাঁর ধারণা সবই কল্যাণকর।” (তাফসীরে দুররে মানছুর ২৬নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬৫; এবং সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ২৮২; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত সুনানে ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৫৭) মহামানবের মর্যাদা প্রসঙ্গে হযরত জালালউদ্দিন রুমি (রহ.) বলেন, “এ কাবায় হযরত ইব্রাহিম (আ.) বসবাস করতেন, আর মু’মিন ব্যক্তির দিল কাবাতে আল্লাহ্ নিজে বসবাস করেন।”


সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন, “যেহেতু সকল নবি ও রাসুলের মাঝে ঐ একই নুরে মোহাম্মদী বা সিরাজুম মুনির অবস্থান করেছিল সেজন্য সকল নবি ও রাসুল মুক্তার মালার ন্যায় একই সুতায় গাঁথা। আর এ জন্যই তাঁরা পরস্পর একই বংশধর এবং তাঁরা একই মালিকের পরিবারভুক্ত। নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে রাসুলের সিরাজুম মুনিরের ধারক ও বাহক মহামানবগণ অলী-আল্লাহ্, ইমাম, মোজাদ্দেদ বা সূফী সম্রাট হিসেবে পরিচিত হবেন। স্থান কাল পাত্র ভেদে এ নুরে মোহাম্মদী বিভিন্ন নামে জগতের বুকে পরিচয় লাভ করে থাকে। আর সকল নবি, রাসুল এবং অলী-আল্লাহ্গণ ঐ সিরাজুম মুনিরের অধিকারী হওয়ার কারণেই তাঁদের মারেফাত যেমনি এক এবং অভিন্ন, তেমনি তাঁরা পরস্পর একই বংশধর।” (তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী, ১ম খণ্ড) দয়াল রাসুল (সা.) ফরমান, “আমি আদম সন্তানদের প্রত্যেক যুগের উত্তম শ্রেণিতে যুগের পর যুগ প্রেরিত হয়েছি। অতঃপর ঐ যুগে প্রেরিত হয়েছি, যে যুগে আমি বর্তমানে আছি।” (বোখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০৩) নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগেও নুরে মোহাম্মদী বা সিরাজুম মুনির দয়াল রাসুলের বংশ হতেই আগমন করবেন। আমরা যদি পবিত্র হজের প্রকৃত হাকিকত অন্তরের আলো দিয়ে অনুধাবন করি তাহলে দেখতে পাব, হজের মূল শিক্ষাই হলো মহামানবগণের অনুসরণ ও তাঁদের চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ। তাই মুক্তি পেতে হলে যিনি নুরে মোহাম্মদীর ধারক তাঁকে অনুসরণ ও তাঁর শিক্ষাকে গ্রহণ করতে হবে। তাঁর শিক্ষা অনুযায়ী হজের সকল কার্য সম্পন্ন করতে পারলে হজের ফায়েজ, বরকত, রহমত ও ফজিলত লাভ করা যাবে। মহান আল্লাহ্ আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *