মুস্তাক মুহাম্মদ
সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪) রম্য রচনায় বাংলা সাহিত্যে প্রবাদপুরুষ। মানুষকে হাসানো সহজ কাজ নয়। আর সেই কাজটি অতি সহজে করেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। যে কোনো বক্তব্যকে নিয়ে তিনি হাস্যরস করেছেন। অত্যন্ত গম্ভীর বিষয়কে তিনি রম্য কায়দায় উপস্থাপন করেছেন। তাতে বিষয়টি হালকা হয়নি বরং আরো উপভোগ্য, হৃদয়গ্রাহি হয়েছে। রম্য রচনার রস সহজে যাতে পাঠক আস্বাদন করে, একটু হলেও হাসির খোরাক জোগায় সেই চেষ্টাই তিনি জীবনভর করে গেছেন। বর্তমান বিজ্ঞান নির্ভর ব্যস্ত সময়ে আমরা একঘেয়েমি হয়ে যাচ্ছি নিত্য। এই এক ঘেয়েমিতা দূর করার জন্য হাস্যরসের প্রয়োজন। একটা তুচ্ছ বিষয়ও মুজতবার আলীর হাতে পড়ে উপভোগ্য হয়ে উঠে। বক্তব্যে রয়েছে গভীর জীবনবোধ। বুদ্ধির চমৎকার ব্যবহার লক্ষণীয়। একঘেয়েমি জীবনে তার রচনা পড়লে হাসির রোল উঠতে বাধ্য। তিনি হাস্যরসের প্রাণভ্রমরা, বাংলা রম্যরচনার প্রাণপুরুষ।
‘রসগোল্লা’ রম্য রচনা পড়ে কে না হাস্যরসে হাবুডুবু খেয়েছে? রসগোল্লা রম্যগল্পের পাঠকমাত্র তা স্বীকার করবেন। কাহিনিটাও চমৎকার। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ঝান্ডুদা বন্ধুর মেয়ের জন্য এক টিন ভ্যাকুম প্যাকেটজাত মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছে। ইতালির কাস্টমস ঘরে কাস্টমস অফিসারের সাথে তা নিয়ে বাকবিতন্ডা হয়। কাস্টমস কর্মকর্তাকে তিনি বোঝাতে ব্যর্থ হয় যে, প্যাকেট খুললে মিষ্টি নষ্ট হয়ে যাবে। কাস্টমস অফিসারের ভাঙাচোরা চেহারার বর্ণনা আমাদেরকে রসগোল্লা খাওয়ার আগে রসে মজায়ে ফেলে। তাছাড়া ঝান্ডুদার পোশাক ব্যাগের উপরে বিভিন্ন দেশের কাস্টমস হাইজের সিল সব কিছুতে রসের প্রাচুর্য আছে। সেখানে নানা হাস্যরসাত্মক কান্ড ঘটানোর পরেও ঝান্ডুদাকে মিষ্টান্নের প্যাকেট খুলতে হয়। আর প্যাকেট খোলার পরে ঘটে সেই আসল ঘটনা। পাঠক মাত্রই সেই ঘটনায় হেসে ফেলবেন। একগুয়েমি কর্মকর্তার একগুয়েমিতার কারণে ঝান্ডুদা প্যাকেট খোলে। কিছু বুজে উঠার আগেই ঝান্ডুদা ক্ষেপে রসগোল্লা নিয়ে চুঙ্গিওয়ালার নাকে-মুখে লেপে দেয়। আর সকলকে রসগোল্লা দেয়। রসগোল্লার রসে মজে ফরাসি উকিল আড়াই মিনিট চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। সকলেই রসগোল্লার রসে মজে আবার রসগোল্লা খেতে চাই কিন্তু ততক্ষণে তা শেষ। এই রম্য রচনার প্রতিটি চরিত্র হাস্যরসের উদ্রেগ করে। কাহিনিটা সাধারণ হলেও পাঠক পড়লে হাসতে বাধ্য থাকবে। রসগোল্লার রসে মজে ঝান্ডুদাকে ক্ষমা করে দেন কর্তৃপক্ষ। এই যাত্রায় ঝান্ডুদা বেঁচে যান।
পৃথিবীতে মানুষ যে কাজ করুক না কেনো তার পেছনে উদ্দেশ্য থাকেÑ সুখ। সুখের জন্য সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ নিরন্তন ছুটে চললেও সুখ যে কিসে তা এখনো কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি। কিন্তু সুখ পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটিয়ে নিয়ে চলছে মানুষকে। কেউ হয়তো সাময়িক সুখকে বশ করতে পারলেও স্থায়ী রূপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আসলে সুখ কি? এর সংজ্ঞা ব্যক্তি বিশেষ ভিন্ন ভিন্ন। সুখ হচ্ছে অনুভবের বিষয়। জগতের সবকিছুর মধ্যে সুখ আছে। আমাদেরকে সেটা উপলব্ধি করতে হবে। সুখ আপেক্ষিক বিষয়। কেউ খেলে আনন্দ পায়। কেউ খেয়ে, কেউ গল্প করে। যে যে ভাবে পারে সুখে থাকতে চেষ্টা করে। এক জন যার মধ্যে সুখ পায় অন্যে তার মধ্যে সুখ নাও পেতে পারে। এই বিষয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী ‘সুখী হবার পন্থা’ শীর্ষক রম্যপ্রবন্ধ লিখেছেন। বিভিন্ন্ মনীষীর সুখ সম্পর্কে অনুভূতিগুলোকে প্রসঙ্গক্রমে তিনি উল্লেখ করেছেন। যেখানে রয়েছে লালন, কাল্দিাস, চন্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ওমর খৈয়াম, চার্বাক, জার্মানের হাইনে, গ্যাটো প্রমুখ। গ্যাটের কথা উদ্ধৃতি দিয়েছেনÑ সুখ হাতের কাছেই থাকে; তবে তাকে ধরার কৌশলটি শিখতে হয়। চাবার্ক বলেছেনÑ ঋণ করে হলেও ঘি খাও; কারণ দেহ ভস্মীভূত হবে। শীতের রাতে কম্বল (কাঁথা বা লেপ) সরে গেলে আবার তা টেনে শরীরে দিলে সুখ লাগে। খৈয়ামের পাশে বসে কেউ সংগীত পরিবেশন করলে তা বিজন প্রান্ত হলেও তার সুখ লাগে। এমন অনেক রকম সুখের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন রচনাটিতে। আসলে দুঃখকে জয় করাই সুখ। একাধারে কেউ সুখ পায় না, আবার কেউ একাধারে দুঃখও পায় না। সুখ-দুঃখ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সুখ অনুভূতির ব্যাপার। দুঃখকে কঠোর সাধনার মাধ্যমে জয় করে সুখের সোপানে আরোহণ করাই হচ্ছে প্রকৃত সুখ। যে যেখানে আছে সেখান থেকে আত্মতুষ্টি হচ্ছে প্রকৃত সুখ। সুখ খোঁজার জন্য লালন দিল্লি গিয়েছিলেন। আসলে সুখ কি তিনি পেয়েছিলেন? পাইনি। সুখÑযার যে জায়গা আছে, সেখানে থেকে আত্মতুষ্টি অর্জন করতে পারলে সুখের দেখা পাওয়া সম্ভব।
আজকাল প্রায় শোনা যায় স্ত্রী নির্যাতন কেইস (মামলা) আছে স্বামী নির্যাতন কেইস নেই! আসলে পুরুষশাষিত সমাজে স্বামী নারীদেরকে নির্যাতন করে পেশি শক্তির বলে। কিন্তু পেশি শক্তিতে না পারলেও মানসিক শক্তিতে নারীরাও নির্যাতন করতে পারে। আধুনিক যুগে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক সংসার আছে যেখানে নারীরা কর্তৃত্ব করে। এমন কি স্ত্রীরা মানসিক উৎপীড়নে স্বামীর জীবনকে বিষিয়ে তোলে। এটা বিপরীত ঘটনা বলে হাসির কারণ হতে পারে। এমন কাহিনীর সাথে একটু রঙ চড়িয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন ‘দাম্পত্য জীবন’। যেখানে স্বামীরা স্ত্রীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মিছিল-মিটিং করে। এমন একটি সভা চলাকালে শোনা গেল স্ত্রীরা ঝাটা নিয়ে সভা পন্ড করতে আসছে। এই খবর রটার সাথে সাথে সভাস্থল খালি হয়ে গেল। একমাত্র সভাপতি সেখান থেকে নড়ল না। পাঠকের মনে হতে পারেÑ তাহলে কি একমাত্র সভাপতি বীরপুরুষ? না, কেউই বীরপুরুষ নয়। দারোয়ান গিয়ে দেখল সভাপতি মারা গেছে। সভাপতির চিরতরে পালানোটা ট্রাজেডি কিন্তু এখানেও না হেসে পারা যায় না। পাঠকের মনের কোণে অদ্ভুত হাসির সুড়সুড়ি দেয়। এই রকম ট্রাজেডি আমাদের আবেগ আপ্লম্নত করে না। বরং হাস্যরসের কারণ হয়। কিন্তু পাশাপাশি আমাদের এও চিন্তা করতে হবেÑ সব ক্ষেত্রে কিন্তু এমন না। স্বামী-স্ত্রীর সুখের সংসারও আছে। আবার পুরুষই স্ত্রীকে দজ্জাল টাইপের হয়ে উঠতে বাধ্য করে। স্বামীর বিভিন্ন মূর্খতার কারণে অধিকাংশ এমন হয়। এই সব বিষয় নিয়ে হাস্যরসের রম্য রচনায় সিদ্ধহস্ত সৈয়দ মুজতবা আলী।
শান্তি নিকেতন ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘রবি-পুরাণ’। শান্তি নিকেতনে মারাঠি ছেলে ভান্ডার রবীন্দ্রনাথকে সন্ন্যাসী ভেবে তাকে একটি আধুলি দিয়েছিলো। রবিঠাকুর সে নৈবেদ্য গ্রহণ করেছিল। এখানে মুজতবা আলী আরো যোগ করেছেন রবিঠাকুরের কাছ থেকে একবার একটা লোক দশ টাকা ধার নিয়ে বলেছিলÑ চির ঋণী হয়ে থাকলাম। রবি ঠাকুর তার নাতি দিনেন্দ্রনাথকে বলেছিলÑ লোকটার শত দোষ থাকলেও একটা গুণ ছিল। লোকটা সত্যভাষী। এই কাহিনী আমাদের রসের সন্ধান দেয়। হাসির কারণ হয়। কিন্তু তা বাস্তব সম্মত। মুজতবা আলীর উপস্থাপনা শৈলীতে তা আরো মুগ্ধকর হয়ে উঠে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে সত্য মৃত্যু। যা জীবন মাত্রই গ্রহণ করবে। জীবনের করুণতম উপলব্ধিতেও মুজতবার দৃষ্টি ছিল। রবি ঠাকুর শৈশবে মাকে হারান। সাত-আট বছরের সময় বিয়ে করা কাদম্বরীকে হারান বাইশ বছর বয়সে। একচল্লিশ বছরে গেল দ্বিতীয় স্ত্রী। তারপর মেয়ে রেনুকা মারা যান তারপরে বড়ো মেয়ে, ছেলে, নাতি একে একে চলে যেতে থাকে কিন্তু এত মৃত্যুর মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ অপরাজেয়। হাস্য রসিক মুজতবার মধ্যে যে করুণ রস ছিল তা ‘মৃত্যু’ শীর্ষক রচনা পড়লে বোঝা যায়। জীবন রসিক দরদি এই শিল্পীর কলমে হাস্যরসের মতো করুণ রসও প্রজ্বল। জীবনের সহজ-সরল দিক নিয়ে তিনি যেমন হাস্যরসের জোগান দিয়েছেন তেমনি গম্ভীর দিকগুলোও তুলে এনেছেন সহজ করেÑ হাস্যরসের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে ড. রহমান হাবিবের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেনÑ ‘জীবনের গভীরতর ভেতর থেকে জীবনকে পর্যবেক্ষেণের অন্তর্দৃষ্টি মুজতবার ছিল বলেই তার পরিবেশিত হাস্যরসের মধ্যে পরিমিত জীবনময়তা ছিল। জীবনের বেদনাক্লিষ্ট এবং করুণতম অভিজ্ঞতাকে মুজতবা সংবেদনশীলতার প্রাজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে দেখতে পেয়েছেন বলেই বাংলা হাস্যরস সাহিত্যে তার অবস্থান শাশ্বত।’ (সৈয়দ মুজতবা আলী বুদ্ধিদীপ্ত জীবনরসিক, ড. রহমান হাবিব, দৈনিক আমার দেশÑ সাহিত্য সাময়িকী, শুক্রবার ১১ জানুয়ারি ২০১৩)
সৈয়দ মুজতবা আলী জীবনে ঘটে যাওয়া নানা তুচ্ছ ঘটনাকে অবলম্বন করে গড়ে তুলেছেন রম্য রচনা ভুবন। যেখানে একবার অবগাহন করলে হাসিতে জীবন ভরে যায়। মুজতবার হাতে পড়ে যেকোনো ঘটনা একবারে আমোদের মর্মে প্রবেশ করে হাসির খোরাক জোগায়। কখনো করুণ রস কখনো হাস্য রসে তার রচনা পরিপূর্ণ। আলোর বিপরীত যেমন অন্ধকার তেমনি হাস্যরসের বিপরীত করুণ রস। তিনি জীবনের করুণ দিকগুলো সুস্পষ্টভাবে জানতো বলেই জীবনের হাস্যরসের দিকগুলো নিপুণভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। তার লেখনিতে হাস্যরস কিন্তু বাস্তব বিবর্জিত নয়। বাস্তবকে ধরে সত্য উন্মোচনে তিনি হাস্যরসের রম্য রচনা সৃষ্টি করেছেন। এই হাস্যরসের রম্য রচনার কারণে বাংলা সাহিত্যে তিনি চিরকাল প্রাসঙ্গিক হবেনÑ এইটুকু বলতে পারা অবান্তর নয়।
তথ্যসূত্র: সৈয়দ মুজতবা আলীর শ্রেষ্ঠ রম্য রচনা- স্টুডেন্ট ওয়েজ