সুষম খাদ্যের মতো সুষম উন্নয়ন জরুরি

সুষম খাদ্যের মতো সুষম উন্নয়ন জরুরি

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: ইতিপূর্বে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন যে, শ্রেণি-পেশানির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে সরকার কাজ করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুষম উন্নয়ন আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম মূল ভাবনা। কারণ, বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক উন্নয়নকাজ। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানকে বিবিধ বৈষ্যমে তিমিরাচ্ছন্ন করে রোখেছিল; কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, স্বাধীনতার অর্ধশতক বছর পরেও সুষম উন্নয়নে আমরা এখনো যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছি। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে এই বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬.৫ শতাংশ, বর্তমানে তা ২৬.৯ শতাংশ। অথচ বরিশাল অঞ্চলটি শস্যভান্ডার হিসাবে পরিচিত। আবার বরিশাল বিভাগেই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সবচাইতে অধিক। সেই হিসাবে সেইখানে দারিদ্র্য হ্রাস হবার কথা। তবে কারো মতে, দারিদ্র্যের হার অধিক বলিয়াই সেইখানে সামাজিক নিরাপত্তা অধিক। জরিপে আরো প্রকাশ পেয়েছে যে, ঢাকায় বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ১৭.৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৫.৮ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৬.৭ শতাংশ, সিলেটে ১৭.৪ শতাংশ, রংপুরে ২৪.৮ শতাংশ, আর ময়মনসিংহে ২৪.২ শতাংশ। গত ছয় বছরে ঢাকা, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বাকিগুলিতে কমেছে। সব মিলে দেশে এখন সার্বিক দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ। ছয় বছর পূর্বে অর্থাৎ ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩ শতাংশ। দেশে অতিদারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ; ছয় বছর পূর্বে এই হার ছিল ১২.৯ শতাংশ। কয়েক মাস পূর্বে ‘ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’-এর (আইপিডি) একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের এডিপি প্রকল্পে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত সাতটি জেলাই মোট বরাদ্দের ৫০ শতাংশ বরাদ্দ পাচ্ছে, অথচ স্বল্প বরাদ্দপ্রাপ্ত ২৫টি জেলা পাচ্ছে মাত্র ১৩ শতাংশ। বৈষম্য পরিমাপক ‘পালমা রেশিও’ অনুযায়ী ইহার মান ৩.৭২, যাহা এখনো দেশের মধ্যে উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের উচ্চ বৈষম্যকেই নির্দেশ করে।


তবে আশার কথা হলো, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অবকাঠামো ও উন্নয়ন উদ্যোগের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উন্নয়নবৈষম্য হ্রাসের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রেও আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে হবে। এ সকল বৈষম্য দূরীভূত করা না গেলে বাংলাদেশের সুষম উন্নয়ন সম্ভব হবে না। এতে এ সকল অঞ্চল দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়নে পিছিয়ে পড়ছে। এছাড়াও বাংলাদেশের সুষম আঞ্চলিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিশেষায়িত এলাকা তথা পাহাড়ি অঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল, হাওর এলাকা ও চরাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের নগরায়ণে ঢাকাকেন্দ্রিকতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অন্যদিকে অন্যান্য বিভাগীয় শহরসহ জেলা, উপজেলা ও পৌর এলাকার নগরায়ণ হচ্ছে অগোছালো ও অপরিকল্পিতভাবে। স্বাভাবিকভাবেই এটা আমাদের সুষম, পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।


আমরা জানি, কর্মসংস্থান, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা-মূলত এ তিন কারণে মানুষ গ্রাম হতে শহরে আসতে চায়। সমগ্র দেশে সুষম বিনিয়োগের মাধ্যমেই কেবল বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভব। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে, শহরের সুবিধা গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সরকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে। শহরের সুবিধা যখন গ্রামে যাবে এবং গ্রামের সুবিধা যখন শহরে পাওয়া যাবে তখনই ভারসাম্যপূর্ণ ও সুষম উন্নয়ন হবে। আমরা আশা করব, সুষম এ উন্নয়নের ধারা হবে পরিকল্পিত ও ভারসাম্যপূর্ণ। প্রতিটি পিছিয়ে পড়া জেলা তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন পরিকাঠামোর মধ্যে আসলে তার দেশেরও সার্বিক স্থিতিশীলতা ও উন্নতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম মূল ভাবনা দেশের ‘সুষম উন্নয়ন’ বাংলাদেশের প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে দিতে হবে। শরীরের জন্য যেমন সুষম খাদ্য, তেমনি দেশের জন্য সুষম উন্নয়ন জরুরি।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *