সাহিত্যে জীবনের অনুরণন

সাহিত্যে জীবনের অনুরণন

মোহীত উল আলম: মানুষের জীবন চাওয়া-পাওয়ার দ্বৈত রথে চলে। সে পায়, সে পেতে চায়। যত পায়, আরো পেতে চায়। আবার একই সঙ্গে সে বোঝে জীবনে না পাওয়ার বা পেয়ে হারানোর দুঃখও কম ব্যাপ্ত নয়।


রবীন্দ্রনাথ হয়তো ‘কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা’ বলেই জীবনের এই দ্বৈত রূপকে অবলোকন করেছেন। তবে ধর্মে পরকালের বিষয়-আশয় নিয়ে সমৃদ্ধকর যত চিত্রই আঁকা হোক না, প্রতিটা মানুষের শেষ কথা হলো, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ জীবনের রূপ-রস-স্পর্শ-গন্ধের টান অস্বীকার করা যায় না। জীবননান্দ দাশ বলছেন, ‘গলিত-স্থবির ব্যাঙ আরও দু’মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে/আরেকটি প্রভাতের ইশারায়’ (আট বছর আগের একদিন)।


তার পরও মানুষ জানে যে তাকে একদিন এ মর্ত্যধাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাহলে কী করতে হবে? প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস খিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মর্ত্যের জীবনে সুখের খোঁজে একটি তত্ত¡ জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। সেটি হলো যার যে অবস্থানই থাকুক না কেন, সে যদি শারীরিক এবং মানসিকভাবে শান্তিতে থাকে, সেটাই হবে তার জীবনের জন্য পরম অর্থ। এপিকিউরাসের পরিচ্ছন্ন সুখের ধারণাকে পরবর্তী সময়ে ভ্রষ্ট মতবাদ ‘ইট, ড্রিংক অ্যান্ড বি মেরি’ বা খাওদাও, পান আর ফুর্তি করো, এই অতিমাত্রিক কেজো পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়।


কিন্তু এর প্রায় পাঁচ শ বছর পরে রোমান কবি হোরেস এর একটি সম্প্রসারিত ভাষ্য দিলেন। তিনি বললেন, জীবনে যত দিন বাঁচো, আনন্দের মধ্য দিয়ে বাঁচো। ‘কার্পে ডিয়েম’ বা ইংরেজিতে ‘সিজ দ্য ডে’ ধারণাটির আলোকে ফার্সি কবি ওমর খৈয়াম লিখলেন, তাঁর অত্যন্ত পরিচিত রুবাই, কান্তিচন্দ্র ঘোষের অনুপম অনুবাদে: ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও/বাকির খাতায় শূন্য থাক। /দূরের বাদ্য শুনে সে কি লাভ/মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’ কবি এ রুবাইটিতে জীবনকে দুহাত ভরে উপভোগ করার নেশার কথা বলেছেন।

এই একই চিন্তার প্রতিফলন দেখতে পাই আধুনিক ইংরেজ কবি ও পণ্ডিত এ ই হাউসম্যানের ‘লাভলিয়েস্ট অব ট্রিজ দ্য চেরি নাও’ কবিতায়। চেরি ফুলের বনে গাছে গাছে, ডালে ডালে চেরি ফুল ফুটে সাদা বরফে আবৃত হয়ে চমৎকার একটি নৈসর্গিক দৃশ্য উপহার দিচ্ছে। কবিতার কথক তখন বলছেন, আমার এখন বিশ বসন্ত যাচ্ছে। হয়তো আমি সত্তর বসন্ত পর্যন্ত আয়ু পাব। বাকি থাকছে তাহলে আর পঞ্চাশ বসন্ত। কিন্তু পঞ্চাশ বসন্ত বা পঞ্চাশ বছর জগতের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য খুবই অল্প সময়। কাজেই আমি এখনই ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে পড়ব চেরি বনরাজির সৌন্দর্য চাখতে। কোনো সময় নষ্ট করা যাবে না। কবি নজরুল এই ধারারই উদ্ভাবক হয়ে লিখেছেন, ‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগত্টাকে,/কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।/দেশ হতে দেশ দেশান্তরে,/ছুটছে তারা কেমন করে,/কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,/কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণাকে।’


আমাদের কার্পে ডিয়েমজনক চিন্তাটাকে নজরুল একটি সংকটের মাঝখানে এনে দাঁড় করালেন। মানুষ অভিযাত্রাপ্রিয়, সে ঘরের কোণে থাকবে না, কিন্তু এই জীবনতৃষার মুদ্রার উল্টো পিঠে ঠিক দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু, শেকসপিয়ারের ভাষায়, নগ্ন কাস্তে হাতে চাষির মতো, যার হাতে শস্য কর্তনের মতো খণ্ডিত হয় মনুষ্যমস্তক। নজরুলের বীরোচিত ভাষায় মানুষ অভিযাত্রা থেকে সরে আসবে না, সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না, এবং তাতে যদি তার মৃত্যুও হয়, সে মৃত্যুকে সে আগ বাড়িয়ে বরণ করে বলবে, ‘ভালো আছ ভাই?’ হাউসম্যানেরই আরেকজন সতীর্থ ইংরেজ কবি সিগফ্রিড সাসুন ‘সৈনিকেরা হলো স্বাপ্নিক’ শীর্ষক চমৎকার একটি কবিতায় বলছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের মুখোমুখি যখন সৈনিকেরা হয়, তখন তারা মৃত্যুর কথা নিশ্চিত জেনেও মৃত্যুভয় কাতরতায় ভোগে না, বরং তারা এই স্বপ্ন নিয়ে থাকে যে তারা একদিন তাদের নিজ নিজ আলোকিত ঘরে ফিরে যাবে, তাদের সুসজ্জিত বিছানায় তারা শোবে, তাদের সুমিষ্ট স্ত্রীদের সঙ্গে তাদের মিলন হবে।


মৃত্যু মানুষ এড়াতে পারে না। সমারসেট মমের অনুগল্প ‘দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা’ তে আছে বাগদাদ শহরের এক বণিক তাঁর ভৃত্যকে বাজারে পাঠিয়েছেন কিছু সওদা করার জন্য। কিছুক্ষণ পর ভৃত্যটি কাঁপতে কাঁপতে এসে বলল, বাজারে যমদূতের সঙ্গে তার ধাক্কা লেগেছে, কাজেই সে আর বাগদাদে থাকবে না। মনিব তাকে একটা ঘোড়া আর কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দূরবর্তী শহর সামারায় পাঠিয়ে দিলেন। সারা দিন ঘোড়া চালনার পর ভৃত্যটি যেইমাত্র সামারার মূল ফটকে পৌঁছাল, দেখল যে যমদূত তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আর বলছে, ‘তুই ঠিক সময়ে এসে গেছিস, আমি তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’


মানুষ মৃত্যুকে এড়াতে পারে না, কিন্তু মৃত্যুভয়কে এড়াতে পারে কি না? শেকসপিয়ারের হ্যামলেট চরিত্রটি বলছে, মানুষ যদি একবার জানত মৃত্যুর ওপারে কী আছে, নিদেনপক্ষে কোনো পরিব্রাজক মৃত্যুপুরী থেকে এসে যদি আমাদের জানাত, তাহলে আমাদের ধারণা পরিষ্কার থাকলে, এই পচাগলা, নির্মম, নিষ্ঠুর, রোগাক্রান্ত, পরাভূত জীবনে বেঁচে থাকার চেয়ে সবাই নিজের বুকে একেকটি ছুরি বিদ্ধ করে ভবলীলা সাঙ্গ করত। কিন্তু যেকোনো ধর্মে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ।


‘মেজার ফর মেজার’ শীর্ষক পরবর্তী আরেকটি নাটকে শেকসপিয়ার হ্যামলেটের ধারণাটিকেই পুনরুক্তি করলেন। ভিয়েনার শাসক ডিউক ভিসেনশিও একজন পাদরির ছদ্মবেশ নিলেন এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি ক্লডিওকে বোঝাতে লাগলেন যে এ জীবনে বেঁচে থাকার মানেই হচ্ছে অফুরন্ত দুর্ভোগের শিকার হওয়া এবং ভারবাহী পশুর মতো ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকা। অথচ মৃত্যু খুব সহজেই একলহমায় জীবন নামের এই নিকৃষ্ট দাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে। ক্লডিও তাই শান্তচিত্তে মৃত্যুকে মেনে নিতে রাজি হয়। কিন্তু যেই মাত্র সে টের পায় যে তার বাঁচার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে, আর সেটি হলো তার বোন ইসাবেলার সতীত্বের বিনিময়ে, তখন সে বোনকে বলে যে তুমি অ্যাঞ্জেলো, যে তখন ভিয়েনার বিকল্প প্রশাসক, তাকে যদি দেহ দাও, কেউ জানতে পারবে না এবং তোমার গায়েও এর কোনো চিহ্ন থাকবে না, অথচ তোমার ভাইটি বেঁচে যাবে। এই ধারণা থেকে ক্লডিও এবার পাদ্রিকে বলে যে সে আসলে মরতে চায় না। কারণ মৃত্যুর পর তার কী হবে তা সে জানে না।


ঠিক আছে মানুষ মরতে চায় না, এ-ও ঠিক আছে যে তার মৃত্যুভয় আছে। কিন্তু এই নশ্বর জীবনটা কাটানোর তরিকা কী হবে? এপিকিউরাসের সুখবাদী পথটি নানা কারণে আসলে রোমান্টিক একটি ধারণা। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলছেন, ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট, ছোট গ্রামগুলি’ (দুই বিঘা জমি) বা ইংরেজ কবি আলেকজান্ডার পোপ যেমন লিখেছিলেন, সেই মানুষই সুখী যার একটি গৃহ আছে, একটি শস্যক্ষেত্র আছে, ভেড়া প্রতিপালনের সামর্থ্য আছে, বা বর্তমানে বাংলাদেশে ‘আমার বাড়ি, আমার খামার’ নামের যে সফল প্রজেক্টটি চলছে, এই পরিসীমায় শহুরে চোখ দিয়ে গ্রামকে দেখলে যেমন মনে হয় গ্রাম হচ্ছে শান্তির আখড়া, কিন্তু আসলে জীবন শহরেই হোক, গ্রামেই হোক, সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে হোক বা পাহাড়ের চূড়ায় হোক, জীবন একটি নিজস্ব ভঙ্গিতে চলে, যার ভিত্তি হচ্ছে যতটা না আনন্দ, তার চেয়ে বেশি দুঃখ, যতটা না শ্রান্তি তার চেয়ে বেশি ক্লান্তি। জীবননান্দ দাশ লিখেছেন, ‘আমাদের ক্লান্ত করে,/ক্লান্ত-ক্লান্ত করে’ (আট বছর আগের একদিন)।

রবীন্দ্রনাথ একটি গানে বলছেন, ‘রয় যে কাঙাল শূন্য হাতে, দিনের শেষে/দেয় সে দেখা নিশীথ রাতের স্বপনবেশে।’ আমার মনে হয় এই যে ‘সে’ তিনিই রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর, যিনি স্বপ্নের বেশ ধরে এসে ‘জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী’ দান করে দেবেন মানুষকে।


তাই জীবনে হতাশ হওয়ার কোনো উপায় নেই, এক দিক থেকে না এক দিক থেকে জীবন অপার মাধুরীতে ভরে উঠবে। জীবনের এই আর্তি ফুটিয়ে তোলাই সাহিত্যর প্রধান অঙ্গীকার।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *