নারী ডেস্ক: বিশ্বায়নের এই যুগে সাইবার দুনিয়ার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে ইন্টারনেটে অবাধ বিচরণ শিশুর নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইডি হ্যাক, তথ্য চুরির মতো সাইবার অপরাধ ঘটছে। এসব অপরাধের শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুরা।
২০২১ সালের তুলনায় এসব অপরাধ ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.৬৪ শতাংশ। চলতি বছরের আগস্ট মাসে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়্যারনেস ফাউন্ডেশনের এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে সোমবার পালিত হয়েছে বিশ্ব শিশু দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘গড়বে শিশু সোনার দেশ, ছড়িয়ে দিয়ে আলোর রেশ’।
বেসরকারি জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্য থেকে জানা যায়, ইন্টারনেটে শিশুরাও পর্নোগ্রাফির শিকার থেকে বাদ যাচ্ছে না। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ১৫ জন মেয়েশিশু।
গ্রামীণফোন, টেলিনর ও ইউনিসেফ গত ৩০ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, তাদের জরিপে দেখা গেছে, ইন্টারনেটে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৯০ শতাংশ অন্তত একবার হলেও পর্নোগ্রাফি দেখেছে। আর ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে। অন্যদিকে প্রায় ৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ১০ থেকে ১৯ বছরের শিশুদের মধ্যে ৭২ শতাংশ ছেলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। মেয়েদের মধ্যে ব্যবহারকারী ৬৩ শতাংশ।
ওই সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে পাঁচ লাখের বেশি শিশু, ৭৩ হাজারের বেশি শিক্ষক এবং ৫০ হাজারের বেশি অভিভাবককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ইউনিসেফ। আর মীনা কার্টুনের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। সচেতনতা বাড়ানোর এই বিষয়গুলো জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম ও টিচার্স গাইডে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চলছে।
সাবিনা সুলতানার (ছদ্মনাম) বয়স ১৬। বাড়ি দিনাজপুর। ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলার কিছুদিনের মধ্যে একটি ফেক আইডি থেকে তাকে অশ্লীল মন্তব্যের পাশাপাশি ছবি পাঠানো শুরু হয়। এ নিয়ে সাবিনার পরিবার সিআইডির সাইবার সেলে অভিযোগ করে। পরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেক আইডির ব্যক্তিটি মেয়েটির দূর সম্পর্কের মামাতো ভাই। মেয়েটিকে সে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু মেয়েটি তা প্রত্যাখ্যান করায় অপরাধের এই পথ বেছে নেয় ছেলেটি। পরে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল পোস্ট ট্যাগ করা, আপত্তিকর ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া, ছবি বিকৃত করে নেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, ব্ল্যাকমেইল করে উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা, ফেক আইডি থেকে অশ্লীল মন্তব্যের পাশাপাশি ভিডিও শেয়ার করে শিশুদের হয়রানি করা হচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) জরিপে উঠে এসেছে, ১৮ বছরের নিচের শিশুদের টার্গেট করে অশালীন কথা বলা, মেসেজ পাঠানো, ছবি কিংবা ভিডিও পাঠানো, প্রেমের সম্পর্কের নামে ব্ল্যাকমেইল করে যৌন হয়রানি বা অর্থ আদায় করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরিচিত লোকদের দ্বারা এসব হয়রানির ঘটনা বেশি ঘটছে। কিছু ক্ষেত্রে পরিচিতজনরাও এমন হয়রানি করে।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়্যারনেস ফাউন্ডেশনের চলতি বছরের আগস্টে প্রকাশিত জরিপে দেখা গেছে, ইন্টারনেটে টার্গেট করা হয় ১৮ বছরের নিচের শিশুদের। ওই জরিপে উঠে এসেছে, ১৩.৫৭ শতাংশ শিশু এরই মধ্যে অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬.৫৫ শতাংশ মেয়েশিশু। ছেলেশিশুর এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে ৪৩.৪৫ শতাংশের।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়্যারনেস ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ বলেন, শিশুদের সাইবারঝুঁকি থেকে রক্ষায় সচেতনতার কাজটি বেশি করতে হবে অভিভাবকদের। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ‘সাইবার পাঠ’। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ‘সাইবার পাঠ’ বাধ্যতামূলক করা উচিত।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের কন্ট্রোলার অব সার্টিফাইয়িং অথরিটিজের ২০১৭ সালের জরিপ থেকে জানা যায়, অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রীদের ৬৯ শতাংশ ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, ইনস্টাগ্রামসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত।
ইউনিসেফের জরিপ বলছে, দেশে ৪৫ শতাংশ শিশু অনলাইনে উত্পীড়নের শিকার হয়। ওই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, অনলাইনে উত্পীড়ন ও সহিংসতা বন্ধে দায়িত্ব কার, জানতে চাইলে ৩২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছে, এ দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জরিপে দেখা গেছে, সাইবার অপরাধের শিকার ৫ শতাংশের কম শিশু অভিযোগ দায়ের করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হলেও ডিজিটাল মাধ্যমে শিশুদের নির্যাতনের শিকার প্রতিকারে যে বিধান থাকা প্রয়োজন ছিল সেটি নেই। ডিজিটাল মাধ্যমে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অপরাধ করলে যে শাস্তি দেওয়া হবে, শিশুর জন্যও একই বিধান রাখা হয়েছে।
২০১৩ সালের শিশু আইনে বলা হয়েছে, অন্য আইনে বিচারপ্রক্রিয়া যা-ই থাকুক, একজন শিশুর বিচার করবেন শিশু আদালত। ফলে সাইবার মামলায় শিশু আসামি হলে সে বিষয়ে শিশু আদালতের রায় দেওয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কায় রয়েছেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ বলেন, ‘ইন্টারনেটে ভুক্তভোগী বেশির ভাগই মেয়ে। অপরাধীর বেশির ভাগ ছেলে। প্রতিবছরই বাড়ছে ভুক্তভোগীর সংখ্যা। তবে আমরা অভিযোগ পেলে দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।’