শামীম আহমেদ: অফুরন্ত সম্পদের ভান্ডার বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসার পর এই সাগরে দেশের স্থলভাগের প্রায় সমপরিমাণ এলাকার মালিকানা পেয়েছে বাংলাদেশ। সমুদ্রের এই লোনাজলের তলে রয়েছে মূল্যবান খনিজ ও প্রাণিজ সম্পদের বিপুল সম্ভার। বিশেষজ্ঞদের মতে- শুধু সমুদ্রের সম্পদ ব্যবহার করেই দেশের জিডিপি নিয়ে যাওয়া সম্ভব ১০ শতাংশের ওপরে। দূর করা সম্ভব সামগ্রিক বেকারত্ব। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশকে দাঁড় করাতে বড় অবদান রাখতে পারে এই সমুদ্রের নীল অর্থনীতি। সরকারও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে সমুদ্রসীমা বিজয়ের ১০ বছরে প্রস্তুতিতেই সীমাবদ্ধ অনেক উদ্যোগ। এখন পর্যন্ত সমুদ্রের সম্পদ আহরণে অর্জিত হয়নি কোনো অগ্রগতি।
২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের (পিসিএ) রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায়। এছাড়া ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এরপরই সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও গবেষণায় সরকার নানা উদ্যোগ নেয়। সমুদ্রসীমা অর্জনের পরের বছরই ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ। সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ এবং এর যথাযথ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে আহ্বায়ক করে ২৫-সদস্য বিশিষ্ট একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৫ সালে সমুদ্রসম্পদ গবেষণার জন্য কক্সবাজারে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। ২০১৭ সালে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয় ‘ব্লু ইকোনমি সেল’। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয় সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ। ২০১৮ সালে নৌবাহিনী সদর দফতরের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিমরাড) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যানে সমুদ্র অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনায় নীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পাঁচ ধরনের কৌশল ঠিক করা হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো সামুদ্রিক সম্পদের বহুমাত্রিক জরিপ দ্রুত সম্পন্ন করা। গত ১০ বছরে সমুদ্রসম্পদ নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। এর বাইরে সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ছাড়া সম্পদ আহরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। এদিকে হংকং, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, চীনসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ বহুদিন ধরে সমুদ্র অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। সিঙ্গাপুরের জিডিপির ৪০ ভাগ সমুদ্রনির্ভর। ইন্দোনেশিয়া ‘ঞযব খড়সনড়শ ইষঁব ঊপড়হড়সু ওসঢ়ষবসবহঃধঃরড়হ চৎড়মৎধসসব’-এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৭৫ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিসহ প্রতিবছর ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সামুদ্রিক সম্পদের উৎকর্ষসাধন ও পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে বছরে আয় করছে প্রায় ৪৭.২ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার যা তাদের জিডিপির ৩ শতাংশের বেশি। ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটির অর্থনীতিতে ব্লু-ইকোনমির অবদান হবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার। গত পাঁচ বছরে চীনের অর্থনীতিতে ১.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রি বৃদ্ধি পেয়েছে যা চীনের মোট জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ। এছাড়া, দেশটি ব্লু-ইকোনমি কেন্দ্রিক যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে ২০৩৫ সাল নাগাদ জিডিপিতে মেরিন সেক্টরের অবদান হবে প্রায় ১৫ শতাংশ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ব্লু-ইকোনমি হতে বাৎসরিক গ্রস মূল্য সংযোজন ৫০০ বিলিয়ন ইউরো এবং ৫ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক সহায়তা এবং উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি), জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি), বিশ্বব্যাংক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উন্নয়ন কৌশলের মূলেও রয়েছে ব্লু-ইকোনমি (নীল অর্থনীতি)। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন বলেন, যথাযথভাবে সমুদ্রের সম্পদ ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সারা পৃথিবীর সমুদ্রঘেঁষা দেশগুলোই উন্নতি করেছে। সামুদ্রিক অংশীদারি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সম্ভাবনাও প্রচুর। রাতারাতি সমুদ্র সম্পদ আহরণ সম্ভব নয়। তবে সঠিক পরিকল্পনা করে সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের জিডিপি ১০-এর ঘরে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে যে ‘দি টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট’ করেছিলেন, এরপর আর কোনো উন্নয়ন হয়নি। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়েছিল। কিন্তু, এখান থেকে যেসব জনশক্তি বের হচ্ছে তাদের কাজে লাগানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এরা কেউ ব্যাংকে চাকরি করছেন, কেউ এনজিওতে। তবে নতুন সমুদ্রসীমা অর্জনের পর সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিষয়টা গুরুত্ব পেয়েছে। এটা একটা উন্নতি। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হচ্ছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ব্লু-ইকোনমি সেল হয়েছে। পৃথক মেরিটাইম ইউনিট হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ চালু হয়েছে। সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট হয়েছে। এগুলোই উন্নয়ন। কিন্তু, বাধা হচ্ছে সঠিক লোককে সঠিক জায়গায় পদস্থ করা হচ্ছে না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ চালু হলো। তারা পাস করে কীভাবে ব্লু-ইকোনমিতে অবদান রাখবে সেই পলিসি হয়নি। আমাদের মেরিন স্পেশাল প্ল্যানিং দরকার। সমুদ্রের কোনো এলাকা খনিজ সম্পদ, কোনো এলাকা মাছ, আবার কোনো এলাকা পর্যটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ভাগ করে মাস্টার প্ল্যান করা দরকার। না হলে কনফ্লিক্ট হবে। একটা সেক্টরকে গুরুত্ব দিয়ে আরেকটি সেক্টর যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমাদের পুরো সমুদ্রে কোথায় কী আছে, কোনটি আহরণ সম্ভব, কোনটি সম্ভব নয় তা, প্রতি বছর কোন সম্পদ কী পরিমাণ আহরণ করব সেগুলো মাস্টারপ্ল্যানে নিয়ে আসতে হবে। অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ ইকো-সিস্টেম নষ্ট করবে। সমুদ্রদূষণ ঠেকানোটাও একটা চ্যালেঞ্জ।
জানা গেছে, সমুদ্রকে কেন্দ্র করে বিশ্ববাণিজ্যে প্রতি বছর প্রায় ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য সংঘটিত হয়। বর্তমান পৃথিবীর প্রায় ৬৩০ কোটি মানুষের ১৫ শতাংশ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সমুদ্র। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের খনি থেকে। আন্তর্জাতিক আমদানি-রপ্তানির ৬০ ভাগ হয় সমুদ্রপথে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় গ্যাস হাইড্রেট বা মিথেন গ্যাসের জমাট স্তরের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এলাকায় ০.১১ থেকে ০.৬৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট জমা আছে, যা ১৭-১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের সমান। এ ছাড়া বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে প্রায় ১০ লাখ টন খনিজ বালু উত্তোলন সম্ভব। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ নডিউল, ফসফরাস ডেপোজিট, পলিমেটালিক সালফাইড, অ্যাডাপোরাইট ও ক্লেসার ডেপোজিট নামের আকরিক। এসব আকরিক পরিশোধনের মাধ্যমে পাওয়া যাবে মলিবডেনাম, কোবাল্ট, কপার, জিংক, লেডসহ অনেক দুর্লভ ধাতু, যা জাহাজ নির্মাণ ও রাসায়নিক কারখানায় ব্যবহার করা যাবে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, অগভীর সমুদ্রের তলদেশে ভ্যানাডিয়াম, প্লাটিনাম, কোবাল্ট, মলিবডেনাম, ম্যাঙ্গানিজ ক্রাস্ট, তামা, সিসা, জিংক এবং কিছু পরিমাণ সোনা ও রুপা দিয়ে গঠিত সালফাইডের অস্তিত্ব রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের প্রায় ৩০ থেকে ৮০ মিটার গভীরে সিমেন্টশিল্পের কাঁচামাল ‘ক্লে’র বিশাল ভান্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে মহামূল্যবান ধাতু ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সমুদ্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’-এর মহাসচিব মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, স্বাদু পানির ২৭০ প্রজাতির মাছের বিপরীতে আমাদের সমুদ্রে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছ আছে। প্রতি বছর বঙ্গোপসাগর হতে প্রায় ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু, আমরা মাত্র ৭ লাখ টন মাছ ধরছি। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই প্রাণিজ সম্পদ আহরণ বাড়ানো সম্ভব। বিভিন্ন দেশ সমুদ্র পর্যটনের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয় করলেও পরিকল্পনার অভাবে এখানে হচ্ছে না। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমার তলদেশে যে সম্পদ রয়েছে, তা টেকসই উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। অথচ সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ার পর বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশ বছরে মাত্র ৯৬০ কোটি ডলারের সম্পদ আহরণ করছে। সাগরময় দ্রুত বিচরণশীল মাছ আমরা ধরতে না পারলেও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের জেলেরা ঠিকই আহরণ করছে।