সংগীত ও মানব জীবন

সংগীত ও মানব জীবন

মোহাম্মদ শোয়েব: একটি প্রাচীন শ্লোকে আছে- ‘সাহিত্য, সংগীত কলা বিহীনা/সাক্ষাত পশু পুচ্ছ বিশাল হীনা।’ অর্থাৎ সাহিত্য ও সংগীত কলা এবং তার সৌন্দর্যের প্রভাব যে সব মানুষ বা ব্যক্তির উপর পরিলক্ষিত হয় না, এই সুন্দর পৃথিবীতে তাকে পশুর সমান গণ্য করা হয়ে থাকে। মানব জীবনে সাহিত্য এবং শিল্পকলার একটি মহত্ত¡পূর্ণ স্থান রয়েছে। প্রত্যেক মানুষ বা ব্যক্তি তার নিজস্ব ইচ্ছা অনুযায়ী তার পছন্দের শিল্প সাহিত্যের দিকটি আয়ত্ব করে এবং সেই বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করে। শুধু আয়ত্ব বা পারদর্শিতাই নয়, সেই শিল্পকলার প্রতি তার আকর্ষণই তাকে মানুষ বলে গণ্য করার জন্য যথেষ্ট।


সংগীত কলার ক্ষেত্র অনেক বিশাল এবং বিস্তৃত। সৃষ্টিকর্তার এই সুবিশাল বিশ্বের প্রতিটি স্থানেই তার নিজস্ব সংগীত সংস্কৃতি এবং তার প্রভাব বিদ্যমান। প্রতিটি স্থানের মানুষই তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও সংগীতে অভ্যস্ত এবং তা আয়ত্ব করে সে পরিতৃপ্তি বোধ করে। আমাদের এই উপমহাদেশে সংগীতের অনেক প্রকার রয়েছে এবং প্রত্যেক প্রকারের মধ্যেই ‘স্বর’ এবং ‘লয়’ এই দুই তত্ত¡ পরিলক্ষিত হয়। এই তত্তে¡র বাইরে সংগীত কলার কথা চিন্তাও করা যায় না। এই দুইয়ের যে কোনো একটার অভাব হলেই সংগীত স্বয়ংসম্পূর্র্ণ হতে পারে না। এই দুই তত্তে¡র প্রভাবই একজন ‘প্রকৃত মানুষ’ নামের ব্যক্তির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। যে সব ব্যক্তির মধ্যে এই দুইয়ের প্রভাব দেখা যায় না, তাকে জগৎ পশুর স্থানে গণ্য করে।
সৃষ্টির প্রথম থেকে প্রলয় পর্যন্ত সংগীতের অস্তি¡ত্বকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। জীবন গ্রন্থের পৃষ্ঠাকে যেদিক থেকেই পাল্টানো হোক না কেন, কোনো অধ্যায়ই এ রকম পাওয়া যাবে না যে অধ্যায়টিকে সংগীত থেকে সরিয়ে ফেলা যায়। যুগস্রষ্টা মানব জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথেই সংগীত বা সুর শ্রবণ করে এবং মৃত্যুর পরও তার উদ্দেশ্যে সংগীতের সুর জ্ঞাপন করা হয়। প্রাণী মাত্রই তার উৎপত্তি সংগীতময় বাতাবরণ এবং সংগীতময় তত্তে¡র দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। স্বর আত্মার নাদ এবং আত্মা পরমাত্মার স্বরূপ। যেভাবে আত্মার সম্বন্ধ পরমাত্মার সাথে মনে করা হয় ঠিক সেভাবেই (অনুরূপভাবেই) স্বরের সম্বন্ধ আত্মার সাথে মানা উচিৎ। এই বক্তব্য স্পষ্ট হয় যে, সংগীত এবং আত্মার সম্পর্ক অত্যন্ত সুদৃঢ়।
ভাবুক ব্যক্তি ছাড়াও যে কোনো পাষাণ হৃদয়ের মানুষই হোক না কেন- সংগীত যে তাকেও স্পর্শ করে না বা সংগীতের বিষয়ে তার বিমুখ মনোভাব এ কথাও মনে করা উচিত নয়। কথায় আছে- ‘গানা ঔর রোনা সভীকো আতাহে’। অর্থাৎ গান এবং কান্না সবারই আসে। সংগীতের ভাষায়- যে ব্যক্তি বিবেক, অভ্যাস এবং তপস্যার মাধ্যমে স্বর এবং লয়ের উপর নিজের অধিকার প্রাপ্ত করে- সেই ব্যক্তি সমাজে তার প্রাপ্য সম্মান অর্জন করে এবং সমাজ তাকে একজন গুণী সঙ্গীতজ্ঞ বলে গণ্য করে। কিন্তু অধিকাংশজন এ রকম যে, তারা ললিতকলার সাধনা এবং তপস্যার থেকে বঞ্চিত থাকে। এই সমস্ত ব্যক্তিবর্গকে গায়ক বলা যায় না বা গায়ক বলার পাত্রও তারা নয়। কিন্তু গান তারাও গেয়ে থাকেন। তাদের জীবনেও সংগীত জড়িত। গ্রামে-গঞ্জে গাওয়া হয়ে থাকে এইরূপ লোকসংগীতের বিভিন্ন প্রকার, কাপড় ধোয়ার সময় ধোপার গান গাওয়া, কোনো ভারী বা কাঠের কাজ করার সময় শ্রমিকের গান, ক্ষেতে কাজ করার সময় কৃষাণের গান, ঘাটে জল তুলতে গিয়ে গ্রামের যুবতী মেয়েদের গান, গরু চরানোর সময় গোয়ালার সংগীত, এ সবই উপরোক্ত বক্তব্যের প্রমাণ বহন করে। এই সমস্ত গান অবশ্যই দৈনিক কাজে কর্মে তাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে। কোনো বিশেষ উৎসবে যেমন বিয়ে, সন্তানের জন্ম, ধর্মীয় উৎসব এবং কোনো সর্বজনীন সমারোহের কার্যক্রম অবশ্যই গীত এবং নৃত্যের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে।


জীবন পথের যে কোনো মোড়ে দাঁড়ালেও দেখা যাবে, সেখানেও সংগীতের সমৃদ্ধ রয়েছে। যেমন- সুখে-দুঃখে, যোগে-বিয়োগে, জীবন-মৃত্যুতে। সারাংশ এটাই যে, যে কোনো দিক দিয়েই হোক না কেন মানব জীবনের প্রত্যেক অবস্থার সাথেই সংগীতের অস্তিত্ব বিদ্যমান। যুদ্ধের মঞ্চে উৎসাহ বৃদ্ধি করার জন্য বর্তমান যুগেও বিশ্বের প্রত্যেক রাষ্ট্রের সৈনিকরা বিভিন্ন প্রকারের সংগীতের প্রয়োগ করে থাকেন। মৃত্যুর সেই বিভৎস বাতাবরণেও সৈনিকদের মস্তিষ্ক ঠিক রাখার জন্য এবং গগণভেদী বোমার ভয়াবহ গর্জনেও কর্তব্যের ধাপে দাঁড়ানোর শক্তি তাদেরকে সংগীতই প্রদান করে।


ভিন্ন ভিন্ন দেশে সংগীতের প্রকার ভিন্ন ভিন্ন হোক না কেন- তার প্রচার এবং গুণেতে রূপান্তর অবশ্যই হয় না। সংগীতের মৌলিক রূপ এবং তার সৃজনাত্মক তত্ত¡ সব দেশের বা জায়গার সংগীতেই সমান হয়ে থাকে। সংগীতের পরমাণু মানববৃত্তি প্রশস্ত করার সাথে সাথে আত্মিক শক্তির আবির্ভাবও ঘটিয়ে থাকে। এই ললিতকলার গভীরতাকে পরিমাপ করার সাধ্য কারো নেই। মানুষ এর গভীরতা থেকে যতই উতরাতে বা পার হতে থাকে ততই তার পথ আরও প্রশস্ত এবং পরিমার্জিত হতে থাকে। কিন্তু এ বিষয়ে সিদ্ধিপ্রাপ্ত করার জন্য মানুষকে কঠিন তপস্যা করতে হয়। একজন ঋষির মতো স্থির হয়ে তাকে সংগীতের বিশাল কক্ষে প্রবিষ্ট হতে হবে, তবেই একমাত্র ‘সংগীত গুণী’ এই যথার্থ শব্দটি তার প্রাপ্য হতে পারে।


প্রসন্নতার কথা এটাই যে, আজকাল পৃথিবীর কিছু বিশেষজ্ঞ এবং ডাক্তার সংগীতের রহস্যপূর্ণ তত্তে¡র অনুসন্ধানে সংলগ্ন রয়েছে। ইদানিংকালের পরীক্ষণ পদ্ধতিতে এমন কিছু চমকপ্রদ উদাহরণ পাওয়া যায়, যার দ্বারা অনুসন্ধানকর্তাদের উৎসাহ দিন দিন বাড়ছে। মানসিক রোগের চিকিৎসা এবং এমন অনেক রোগ রয়েছে যার চিকিৎসা সংগীতের স্বর-লহরীর দ্বারা করা হয়েছে এবং তা আশাতীত লাভজনকও হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ‘বুদ্বিজ্ঞ’ (এক প্রকার জঙ্গলী ঘোড়া) নামক জঙ্গলী ঘোড়াকেও সংগীতের সহায়তায় পালিয়ে পশুর স্থানে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। লন্ডনের একটি হাসপাতালে বোবা, কানে না শোনা রোগী এবং পাগলদের উপরও সাংগীতিক চিকিৎসার প্রয়োগ সফল হয়েছে বলে জানা যায়।
ঙৎ ঔ চধষ তার ‘সংগীত চিকিৎসা’ নামক গ্রন্থে বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর সাহায্যে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার কথা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন। ক্লোরোফর্ম ছাড়াও এখন যে কোনো গম্ভীর নাদের সাহায্যে মস্তিষ্কের নাড়িকে সুদৃপ্ত করা সম্ভব। এই প্রকারের ঔষধ এবং শক্তি দুইভাবেই এই কলা প্রযোজ্য।


সংগীত সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থে রাগ-রাগিণীর বিভিন্ন স্বরূপ এবং তাদের ধ্যানের চর্চার উল্লেখ পাওয়া যায়। এর অভিপ্রায় এটাই যে, রাগ-রাগিণীর শুদ্ধ ধ্যান এবং চর্চা করলে তাদের রূপ সাকার হয়ে উঠে এবং সেই সাকার রূপের আশাই একজন প্রকৃত সংগীত গুণী সব সময়েই করেন। প্রাচীনকালে সামগাণের মন্ত্রের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে আহ্বান জানানোর কথা প্রাচীন গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। এই কথা একেবারেই বিশ্বাস করা যায় না তাও সম্ভব নয়। অতএব, গভীর চিন্তা, শ্রদ্ধা এবং গবেষণার অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে।


দক্ষিণ ভারতের প্রসিদ্ধ অন্নামলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগের কিছু ছাত্র সংগীতের মাধ্যমে গাছের চারায় এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলেছেন। একই প্রকারের দুটো চারার একটাকে সংগীতের স্বরের দ্বারা অনেকদিন ধরে প্রভাবিত করা হয়েছে এবং অন্যটিকে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মের মধ্যেই রাখা হয়েছে। এই পরীক্ষার পর দেখা গেল, যে চারাটিতে সংগীতের প্রভাব ফেলা হয়েছিল সেটি অন্যটির অপেক্ষায় সোয়া গুণ গতিতে বড় হচ্ছিল। এইভাবে অনেক বৃক্ষের আকৃতিকেও স্বর সন্ধান দ্বারা রূপ প্রদান করা হয়েছে এবং তা সফলকামও হয়েছে। তা থেকে বোঝা যায় যে, শুধু মানব জীবনেও নয়, প্রকৃতি জীবনেও সংগীতের প্রভাব প্রযোজ্য এবং প্রয়োজন।


অনুসন্ধানের এই বর্তমান যুগে সেই দিন খুব বেশি দূরে নয় যে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার সাহায্যে সংগীতের লুকানো অনন্ত শক্তির ভাণ্ডার সর্বসাধারণের সামনে চলে আসবে এবং মানব জীবনের সৃজনমূলক কার্যে এই তত্তে¡র অধিক প্রয়োগ হবে। তখন আমাদের মানব সমাজ জীবন ও সংগীতের সম্বন্ধ বা সম্পর্ককে আরও অনেক স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবে। এই আশা অবশ্যই আমরা করতে পারি।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *