মারুফ ইসলাম: বিশ্বসাহিত্যের কিংবদন্তি শেক্সপিয়ার। বলা হয়, ইংরেজরা দুনিয়ার যেসব স্থানে উপনিবেশ গড়েছে, শাসনব্যবস্থার পাশাপাশি তারা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে আরও একটি বিষয়-উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি লিখিত ভাষাতেই প্রকাশিত হয়েছে ষোড়শ শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের লেখা। কালের ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে তাঁর লেখা নাটকগুলোর চরিত্র ও সংলাপ এখনো এত জীবন্ত আর প্রাসঙ্গিক যে আমরা এখনো উচ্চারণ করি শেক্সপিয়ারের সেই অমর সংলাপ-‘টু বি অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দ্য কোশ্চেন’। পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বের অন্তত চার শ কোটি মানুষ শেক্সপিয়ারের নাটক পড়েছেন। অথচ বিস্ময়কর শোনালেও সত্য, শেক্সপিয়ার বেঁচে থাকা অবস্থায় তাঁর কোনো লেখা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি! তাঁর নাটক গ্রন্থভুক্ত হয় তাঁর মৃত্যুর পর। এই ২০২৩ সালে শেক্সপিয়ারের সেই প্রথম প্রকাশিত সমগ্র প্রকাশের চার শ বছর পূর্ণ হচ্ছে। তাই সম্প্রতি সেই সমগ্রের কপিগুলো যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের জনগণের সামনে প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
যেভাবে গ্রন্থিত হলো শেক্সপিয়ারের লেখাগুলো
আজ থেকে চার শ বছর আগে শেক্সপিয়ারের বন্ধু ও সহকর্মীরা তাঁর সব লেখা একত্র করে একটি সমগ্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কাজটি নিঃসন্দেহে জটিল ও দুঃসাধ্য ছিল। কারণ, তখন কাগজ ও মুদ্রণযন্ত্র সহজলভ্য ছিল না। তারপরও তাঁরা কাজটি কেন করেছিলেন? এর পেছনে শেক্সপিয়ারের প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা কাজ করেছিল, নাকি এই নাট্যকারের বই বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের বিষয়টিই মুখ্য ছিল, তা অবশ্য আজও জানা যায়নি।
কীভাবে গ্রন্থিত হয়েছিল শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো?
ইতিহাস বলছে, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, কিং লিয়ার, মার্চেন্ট অব ভেনিসসহ সব জগদ্বিখ্যাত নাটক কেবল অভিনয়ের জন্য লিখেছিলেন শেক্সপিয়ার। এগুলো লেখা হয়েছিল হাতে। তাঁর জীবদ্দশায় সেভাবে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়নি। আসলে তখন নাটক শুধু অভিনয়ের জন্যই লেখা হতো, আলাদা করে নাটক পড়ার চল ছিল না। ফলে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, এই ব্রিটিশ নাট্যকারের অনেক লেখাই পরবর্তীকালে হারিয়ে গেছে। বলা ভালো, ১৫৬৪ সালের ২৩ এপ্রিল জন্ম নেওয়া শেক্সপিয়ার মারা যান ১৬১৬ সালের একই তারিখে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৫২ বছর।
আগেই বলা হয়েছে, মৃত্যুর পরই তাঁর নাটকগুলো একত্র করে গ্রন্থভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। জানা যায়, শেক্সপিয়ারের বন্ধু ও সহকর্মী বেন জনসন এই নাট্যকারের নাটক ও অন্যান্য লেখা নিয়ে একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বইটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
অতঃপর শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর সাত বছর পর ১৬২৩ সালে সম্পন্ন হলো সেই কাজ। অর্থাৎ প্রথমবারের মতো গ্রন্থাকারে উঠে এলেন শেক্সপিয়ার। আর মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার’স কমেডিস, হিস্টোরিস অ্যান্ড ট্র্যাজেডিস শিরোনামে প্রকাশিত সেসব বই পরিচিত হলো শেক্সপিয়ারের ‘ফার্স্ট ফোলিও’ নামে। তত দিনে অবশ্য শেক্সপিয়ারের অনেক লেখাই হারিয়ে গেছে। গবেষকদের ধারণা, শেক্সপিয়ারের অর্ধেক নাটকই এতে স্থান পায়নি।
শেক্সপিয়ার বেঁচে থাকতে ‘কিংস মেন’ নামে গড়ে তুলেছিলেন একটি অভিনয় প্রতিষ্ঠান। সেখানে তাঁর সহযোগী ছিলেন জন হেমিঞ্জেস, হেনরি কনডেল ও রিচার্ড বারবেজ। এই নাট্যকারের মৃত্যুর সাত বছর পর তাঁরাই মূলত লেখাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেন। শেষ অবধি তাঁরা এই নাট্যকারের ১৮টি নাটক গ্রন্থভুক্ত করতে পেরেছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, বাকিগুলো হারিয়ে গিয়েছিল চিরতরে।
শেক্সপিয়ারের সুহৃদরা প্রথমে এই নাট্যকারের হাতে লেখা নাটকের পাণ্ডুলিপিগুলো নিয়ে একটি মুদ্রণ দোকানে যান। সেখানে একজন মুদ্রাক্ষরিক মেটাল টাইপে (একধরনের ধাতব পাত) লেখাগুলো টাইপ করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর সেই বাস্তবতায় কাগজ তখন আজকের মতো এত সুলভ ছিল না, বরং তা ছিল অনেক ব্যয়বহুল। ফলে শেক্সপিয়ারের প্রথম এই বই মেটাল টাইপেই মুদ্রিত হয়েছিল। আর বইটির প্রচ্ছদপৃষ্ঠা তৈরি করা হয়েছিল একটি তামার শিট দিয়ে। সেখানে খোদাই করে আঁকা হয়েছিল শেক্সপিয়ারের প্রতিকৃতি।
মুদ্রণের পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। সমগ্রটি তৈরি করে বিক্রির উপযোগী করতে করতে ১৬২৩ সালের নভেম্বর মাস চলে আসে।
ধারণা করা হয়, প্রথম সমগ্রটি ৭০০ থেকে ৭৫০ কপি তৈরি করা হয়েছিল। কিছু কপিকে ছাগল, ভেড়া বা গরুর বাছুরের চামড়া দিয়ে মোড়ানো হয়েছিল। ধনী থিয়েটারপ্রেমীদের কাছে বিক্রি করার উদ্দেশ্যেই এসব কপি তৈরি করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
শেক্সপিয়ারের প্রথম প্রকাশিত সমগ্রটির ১৫৩টি কপি বর্তমানে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে। তবে এগুলোর বেশির ভাগেরই মূল পৃষ্ঠাগুলো ছেঁড়া। মাত্র ৫৬টি সম্পূর্ণ কপি রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের এক সাবেক ব্যবসায়ী কোলস বলেন, শেক্সপিয়ারের প্রথম সমগ্রটির একটি অক্ষত কপি ২০২০ সালের এক নিলামে এক কোটি ডলারে বিক্রি হয়েছে। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ও ব্রিটিশ লাইব্রেরির ওয়েবসাইট
ফার্স্ট ফোলিওর চার শ বছরে
১৬২৩ সালে ‘ফার্স্ট ফোলিও’ নামে পরিচিত উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের যে প্রথম সমগ্র প্রকাশিত হয়েছিল, এবার তার চার শ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডজুড়ে বইটির টিকে থাকা কপিগুলোর প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও জাদুঘর মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে এখন আর মাত্র ২৩৫টি কপি ফার্স্ট ফোলিও অবশিষ্ট আছে। এদের মধ্যে কেবল ৫২টিতে সব কটি পৃষ্ঠা অক্ষত আছে, আর বাকিগুলো অসম্পূর্ণ।
ব্রিটিশ লাইব্রেরি জানিয়েছে, এ বছরই তারা শেক্সপিয়ারের প্রথম প্রকাশিত সমগ্র নিয়ে একটি প্রদর্শনী করবে। এছাড়া রিচার্ড বিন ও ক্লাইভ কোলম্যানের চিত্রনাট্য অনুযায়ী তৈরি করা হবে একটি ফিচার ফিল্ম।
অন্যদিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শেক্সপিয়ার স্টাডিজের অধ্যাপক এমা স্মিথ দুটি বই প্রকাশ করবেন-দ্যা মেকিং অব শেক্সপিয়ার্স ফার্স্ট ফোলিও এবং শেক্সপিয়ারের ফার্স্ট ফোলিও: ফোর সেঞ্চুরি অব অ্যান আইকনিক শিরোনামে।