শবে বরাতের সংস্কৃতি

শবে বরাতের সংস্কৃতি

আসিফুর রহমান সাগর: পবিত্র লাইলাতুল বরাত সৌভাগ্যের রজনি হিসেবে পরিচিত। মুসলমানদের জন্য ‘অতি পবিত্র রজনি’ হিসেবে পরিচিত শবে বরাত। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইবাদতের মধ্য দিয়ে রাতটি অতিবাহিত করে। উপমহাদেশে শবে বরাত মানে বিকালে বাড়িতে বাড়িতে হালুয়া রুটি বিতরণ আর সারারাত ধরে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকা। ইরান ও ভারতীয় উপমহাদেশে শাবান মাসের এ রজনিকে শবে বরাত বলা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, সিরিয়ার কিছু এলাকা ছাড়া কোথাও ঘটা করে শবে বরাত পালন করা হয় না। এ রাতে গুনাহ ও পাপের অশুভ পরিণাম থেকে মুক্তি পেতে রহমতের জন্য প্রার্থনা করে থাকেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা।
পবিত্র কুরআনে এ রাতকে ‘লাইলাতুল মুবারাকাহ্’ বরকতময় রজনি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিস শরিফে হযরত রাসুল (সা.) এ মহিমান্বিত রাতকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান’ বলে উল্লেখ করেছেন। এ রাতে মুসলমানরা মহান আল্লাহর কাছে মার্জনা প্রার্থনা করে থাকেন। এ কারণে এ রাতকে লাইলাতুল বারকাত বা শবে বরাত বলা হয়।’
পুরোনো ঢাকাবাসীর ঐতিহ্যের অংশ শবে বরাতের আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা। এখন তা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ির বড়রা এদিনে রোজা রাখেন। মেয়েরা দুদিন আগে থেকেই হালুয়া বানানোর কাজ শুরু করে দেন। শবে বরাতে সকাল থেকেই রুটি বানানোর তোড়জোড় শুরু হয় বাড়িতে বাড়িতে। এর সঙ্গে মাংস রান্না। কোনো কোনো বাড়িতে গরুর মাথা রান্নার চল রয়েছে। আর রাতে এশার নামাজের পর থেকেই শুরু হয় ইবাদত-বন্দেগি। মসজিদে মসজিদে যেমন নামাজ পড়তে যান সবাই তেমনি বাসাতেও মেয়েরা সব কাজ শেষ করে নামাজে বসেন। এদিকে, মসজিদে মসজিদে নফল নামাজ আদায়ের পাশাপাশি মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। চলে তাবারুক বিতরণ।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন জানান, ঊনিশশো শতকের শেষের দিকে ঢাকায় শবে বরাত পালন মুসলিম পরিচয় প্রকাশের বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় শবে বরাত একটি বড় ধরনের উৎসবে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে এর সঙ্গে সরকারি ছুটি যুক্ত হওয়ায় সেটি পালনের ব্যাপকতা আরো বেড়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে শবে বরাত পালন ধর্ম এবং সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আতাউর রহমান মিয়াজী বলেন, ফার্সি শব্দ শব অর্থ রাত বা রজনি এবং বরাত শব্দটির মূল অর্থ ভাগ্য। একত্রে এর অর্থ হয় ভাগ্য রজনি। উপমহাদেশে ফার্সি ভাষা প্রায় ৮০০ বছর রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর ৬০০ বছরেরও অধিক কালব্যাপী (১২০৩-১৮৩৭) ফারসি ছিল বাংলার রাষ্ট্রভাষা। তাই এ অঞ্চলে ফার্সি ভাষার প্রভাব রয়ে গেছে।
অধ্যাপক ড. মো. আতাউর রহমান মিয়াজী বলেন, উপমহাদেশে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে পির-আউলিয়াদের মাধ্যমে। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.), হযরত শাহজালাল (রহ.)-সহ এমন পির-দরবেশের মাধ্যমে। তাদের দরবার সবসময় খোলা থাকত। গরিব মানুষদের জন্য সেখানে খাবারের ব্যবস্থাও থাকত। আর বিশেষ বিশেষ দিনে থাকত বিশেষ খাবার। শবে বরাত, শবে কদর, ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এসব দিনে সেখানে ভালো খাবারের আয়োজন থাকত; যা তাদের দরবারে আসা গরিব মানুষদের মাঝে বিতরণ করা হতো। সেখান থেকেই হালুয়া রুটির প্রচলন শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়।
তিনি বলেন, শবে বরাতে হালুয়া রুটি বানানো তা মানুষের মাঝে বিলি করার মধ্যে বাধা নেই। এটা কোনো খারাপ কাজ নয়। ধর্মীয়ভাবে এতে কোনো বাধা নেই। গরিব মানুষকে খাওয়ানোতে আত্মীয়স্বজনদের বাসায় মিষ্টি বিতরণে কোনো বাধা নেই। তবে, বাড়াবাড়ি সবকিছুতেই খারাপ। লোক দেখানো আয়োজন, অতিরিক্ত আয়োজন করে অপচয় করা, সেটা ভালো নয়। এ আয়োজনের মাধ্যমে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার একটি সম্পর্ক আছে।
ইতিহাসবিদ ও গবেষক সাদ উর রহমান বলেন, ঢাকার নওয়াবরা শবে বরাতকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠানিকতার প্রচলন করেন। তারাবাতি, আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালানোসহ পুরো আলোকসজ্জায় সাজানোর প্রচলন তাদের হাত ধরেই শুরু হয়। তবে, পটকা ফোটানোর চল শুরু হয় তরুণদের হাত ধরে। তবে, পটকা ফোটানো খুব বিপজ্জনক। বিশেষ করে, পুরোনো ঢাকার মতো ঘিঞ্জি এলাকায় এটা বড় বিপদের কারণ ঘটতে পারে। তাই এ কাজ থেকে দূরে থাকাই ভালো।
ঘরে তৈরি হয় বুটের ডাল, ময়দা, সুজি বা নেশেস্তার হালুয়া আর গাজরের হালুয়া। মিষ্টির দোকানে পাওয়া যায় মাশকাতের হালুয়া। অনেক পরিবার হালুয়া জমাট করে বরফি আকারে ছাচ দিয়ে কেটে মেহমানের সামনে পরিবেশন করেন। হালুয়া রুটি ছাড়া সচ্ছল পরিবারে পোলাও, কোরমা, ভুনা খিচুড়ি ও হাঁসের মাংস রান্না করা হয়।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *