মো. ঈমাম হোসাইন: পৃথিবীর যে কোনো ভাষার সাহিত্যে শত বছর নিয়ে উপন্যাস, নাটক বা কবিতা নতুন কোনো কীর্তি নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ রচিত ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’, রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ -এ দুটি সাহিত্যকীর্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের উত্থান-পতনের এক জটিল উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’। শতবর্ষ পরের মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথের ভাব-কল্পনার কবিতা ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’। এর সঙ্গে প্রসঙ্গক্রমে আমরা উল্লেখ করতে পারি কথাসাহিত্যিক নূরুদ্দীন জাহাঙ্গীরের ‘মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল’ উপন্যাসটি। রবীন্দ্রনাথের পতিসর আগমনের শতবর্ষ পরে ঐ অঞ্চলে এক স্কুলমাস্টারের রহস্যময় আগমন ও প্রস্থান ঘিরে উপন্যাস ‘মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল’। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, যিনি নিকটজনের কাছে গাবো নামে পরিচিত, ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ উপন্যাসে এমন এক ঐন্দ্রজালিক জাদুময়ী ঘটনার বর্ণনা দেন, যেখানে দেখা বা অদেখা, প্রেম বা অপ্রেম, পৌরাণিক বা লৌকিক, আঞ্চলিক, বাস্তব বা অবাস্তব যে জনমানুষের গল্প বলেন, তা পাঠককে অনেকটা ভূতের আছর লাগার মতো কঠিন আঠায় আটকে রাখে। গোটা ল্যাটিন আমেরিকায় বাস্তবে এরকম কোনো ভূখণ্ডের অস্তিত্ব না থাকলেও গাবোর জাদুময়ী বর্ণনা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা বা ক্যারিবীয় অঞ্চলের এরকম একটি মাকন্দ নগরী ভাবনায় গড়ে তোলা সম্ভব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি রক্ষার্থে বজরায় ভেসে ১৮৯১ সালে পতিসরে আসেন। ঔপন্যাসিক নূরুদ্দীন জাহাঙ্গীরের বর্ণনায়, ‘সে দেখতে পায়, জানুয়ারি ১৩ তারিখ, একটা বজরা এসে পতিসর কাছারিবাড়ির ঘাটে ভিড়েছে। জমিদারের ম্যানেজার আর তহশীলদার সকাল থেকে ঘাটে প্রতীক্ষা করছিল। অবশেষে তাদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে একটি বজরা এসে ঘাটে ভিড়ল। সুদর্শন এক যুবক ধবধবে ধুতি আর পাঞ্জাবির উপর শাল জড়িয়ে নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে চারিদিকের গ্রাম আর মাঠ দেখছেন।’ রবীন্দ্রনাথ পতিসর অবস্থানকালে নদী, প্রকৃতি, গ্রাম, মাঠ আর ধানখেত, সরল মানুষ দেখে দারুণ আকৃষ্ট হন। এখানে বসে তিনি সন্ধ্যা কাব্য, গোরা উপন্যাসের অংশবিশেষ, চিত্রা ও সোনারতরী কাব্যের কিছু কবিতা, য়ুরোপীয়যাত্রীর ডায়রিসহ বেশকিছু গান রচনা করেন। পতিসরের জীবন ও ছবি তাঁর লেখায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমনের শতবর্ষ পরে এই গ্রামে আসেন আবু আসাদ করিম নামের এক শিক্ষিত তরুণ যুবক, রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠে বাংলার শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষক-লেখক আসাদ করিম বিদ্যালয়ে পাঠের অবসরে রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষ আগের দেখা প্রকৃতি, মানুষ, নদীর কূল, জল, নৌকা, খেয়াঘাট, বজরা আপন মনে খুঁজতে থাকেন। শ্রেণিপাঠে তিনি ছাত্রদের কবিতা শোনান, বোঝান, তাদের মধ্যে চিন্তার খোরাক জোগান, আলোকিত করার চেষ্টা করেন-যেমনটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। নূরুদ্দীনের ভাষায়, ‘রবীন্দ্রনাথ পতিসরে এসে উপলব্ধি করেন, গ্রাম বাঁচাতে হলে সমবায় নীতি ছাড়া আমাদের উপায় নেই। ভাগ করা শক্তির অপচয় তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। কবি নিজেই বলেছেন, সাধারণের হিতের জন্য প্রত্যেককে নিজের সামর্থ্যে খাটাইবার অভ্যাস যদি কোনোমতে পাকা হইয়া যায় তাহা হইলেই তোমার চেষ্টা সার্থক হইবে। পল্লীউন্নয়ন কী ভাবে হবে, তার মডেল তৈরি করে পতিসরে বাস্তবায়ন করেন।’
‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ কিংবা ‘মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল’-এ দুটো উপন্যাসে শতবছরের সময় যোগ থাকলেও পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, ক্ষমতা দখল, পালাবদল, সামরিক দুঃশাসনের ভয়াবহ চিত্রের আবছায়া-যা সমালোচক বা গবেষকেরা পাঠোদ্ধার করতে পারেন। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, কলম্বিয়ার রেইন ফরেস্টে স্থাপিত মাকন্দ নগরীর রহস্যময় এই নিঃসঙ্গতা যেন গোটা ল্যাটিন আমেরিকার স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক যুগের কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আমাজনের গহিন জঙ্গলে ও দুর্গম পর্বতমালার গহিনে অবস্থিত স্থানীয় আদিবাসি তামাকচাষিদের বসতি এবং স্প্যানিশদের আমেরিকা আবিষ্কারের পর স্থাপিত উপনিবেশগুলোর মধ্যে তেমন আন্তঃযোগাযোগ ছিল না। তেমনি গাবোর উপন্যাসে মাকন্দ নগরী ও রিওয়াচার অঞ্চলের মধ্যে কোনো ধরনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এই বুয়েন্দিয়া পরিবার। তাই তারা ক্রমশই যেন নিঃসঙ্গ আর একাকিত্বের মধ্যে স্বার্থপর হয়ে ওঠে।
অপরদিকে রবীন্দ্রনাথদের অধিকৃত জমিদারি অঞ্চল কেবল কবির চোখে দেখা শান্ত, স্থির মায়াবী সবুজ পৃথিবীর অংশবিশেষ নয়, এই অঞ্চলে ও তার আশপাশের এলাকায় হয়েছিল তেভাগা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলনসহ কিছু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। তাই এই আত্রাই নদবিধৌত অঞ্চলটি কেবল শান্ত মানুষের জনপথ নয়, এখানকার মানুষ প্রয়োজনমতো হাতে বল্লম, বর্শা, দা, বটি, কাঁচি ও অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়। রবীন্দ্রনাথদের জমিদারি লাটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন-শোষণ আর ব্রিটিশ রাজত্বের সূর্য অস্তমিত হয়। তারপর হলো দেশবিভাগ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা, সামরিক ফরমান জারি, ক্ষতবিক্ষত সংবিধান।
রবীন্দ্রপাঠক, গবেষক ও ঔপন্যাসিক নূরুদ্দীন জাহাঙ্গীর রবীন্দ্রনাথের কবিতার অংশবিশেষ ধার নিয়ে উপন্যাসের নামকরণ করলেন ‘মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল’। বলা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কবিতার পাঠোদ্ধারকারী হিসেবে শতবর্ষ পর কবির আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর জীবনস্মৃতি ও সাহিত্যকর্মকে স্পর্শ করে অতীত আর সমকালীন রাজনীতি, উপনিবেশিক শাসন, স্বাধীনতা পরবর্তী স্বদেশ বাস্তবতা নিয়ে রচনা করেন এই উপন্যাস।
মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একদল দুঃসাহসী মানুষের পর্বতের গহিনে দুর্গম নতুন নগরী পত্তনের মধ্য দিয়ে সেখানকার সামাজিক রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান, বিশ্বাস ও কর্মময় জীবনধারার যে কার্যকারণ সম্পর্ক বর্ণনা করেন, সেখানে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে গড়ে ওঠা বৈচিত্র্যপূর্ণ যৌনতা, জৈবিক রীতিনীতি, একগুঁয়েমিপনা, উদাসীনতা, সামাজিক দ্ব›দ্ব, যুদ্ধ এবং সম্পদ অনুসন্ধানের মতো কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি সেই জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক নিঃসঙ্গতা এবং অনিদ্রা রোগের লক্ষণগুলোর সঙ্গে ল্যাটিন আমেরিকার রাজনৈতিক ও পৌরাণিক সভ্যতা বিকাশের অনিবার্যতা খুব দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়েছে। ঔপন্যাসিক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের ‘মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল’ উপন্যাসে কবিগুরুর পতিসরে আগমন, জমিদারি রক্ষা, সাহিত্যচর্চা ও প্রকৃতিদর্শন প্রভৃতির অন্তরালে আসাদ, কনকচাঁপা, আবুল কাশেম, শশাঙ্ক বাবু, মেম্বারসহ নানা চরিত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক সাম্য, নব্য উপনিবেশ, সামরিক দুঃশাসন প্রভৃতি বলতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো করে সর্বদা প্রকৃতিদর্শনকারী, ভাবুক ও বাচিকশিল্পী স্বল্পসময়ের মধ্যে গ্রামের মানুষের আপনজনে পরিণত হলো। কেবল বিদ্যালয় পাঠে নয়, সামাজিক সমস্যা সমাধানে ও সংস্কৃতি লালনে, মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে এলো লেখক আসাদ করিম। রক্তের সম্পর্ক না হয়েও পরম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হলেন কনকচাঁপা, শশাঙ্ক বাবু, আবুল কাশেমের সঙ্গে। ব্যক্তি থেকে সমাজ পর্যন্ত সবাই যেখানে আসাদ করিমের ভক্ত, অনুরাগী সেখানে আসাদ করিম কি না সর্বহারা, লাল পার্টির সমর্থক, সমাজদ্রোহী ও রাষ্ট্রদ্রোহী যাকে রাষ্ট্রযন্ত্র গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। এটা নিছক ঘটনার বর্ণনা নয়, ঘটনার আড়ালে ঔপন্যাসিক স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে সামরিক, স্বৈরাচারী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তা প্রকারান্তে বলতে চেয়েছেন। উপনিবেশ থেকে নব্যউপনিবেশ-আরো কত কী? হয়তো অনেক কিছুই বলতে চেয়েছেন।
গাবোর উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের উপন্যাস পাঠ করে পাঠক হয়তো বলতে পারেন, শতবর্ষের ব্যবহার এখানে কাকতালীয়। আসলেই কি তাই? এখনো মার্কেজ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, রবীন্দ্রচর্চা এখনো অব্যাহত বাংলাভাষীদের কাছে। শতবর্ষ পরের পাঠকেরা একজন নূরুদ্দীন জাহাঙ্গীরের উপন্যাস ‘মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল’ নিয়ে গবেষণা করতেই পারেন। এটা কেবল রবীন্দ্রচর্চা কিংবা ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কবিতা পাঠ করে পাঠক নূরুদ্দীন জাহাঙ্গীরের ব্যক্তি দায়শোধের প্রচেষ্টা নয়। রবীন্দ্রনাথের আগমনের শতাব্দী বছর পর তিনি অনেককিছু স্পষ্ট করে বলতে পারতেনও। সামাজিক প্রেক্ষাপট তাকে সেই সাহস জোগায়নি। এখনো আমরা বয়ে চলেছি দুশো বছরের উপনিবেশিক শাসন-শোষণের ধারা। যেমনটি বংশানুক্রমিকভাবে বয়ে চলেছে গাবোর বুয়েন্দিয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এই তিন সাহিত্যকীর্তি নিয়ে আজি হতে শতবর্ষ পরের পাঠকও হয়তো সাড়া দেবেন, পাঠোদ্ধার করবেন তাঁদের মতো করে। এটাও ম্যাজিক রিয়েলিজম।