রেনেসাঁস চেতনার উজ্জ্বল প্রতিনিধি কবীর চৌধুরী

রেনেসাঁস চেতনার উজ্জ্বল প্রতিনিধি কবীর চৌধুরী

রাজীব সরকার
জাতীয় অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক কবীর চৌধুরীর জন্মের শতবর্ষ পূরণ হলো গত ৯ ফেব্রুয়ারি। বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী কবীর চৌধুরী ছিলেন যথার্থই রেনেসাঁর উজ্জ্বল প্রতিনিধি। তাঁর জীবনদর্শনের মূল মন্ত্র ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। ইহজাগতিকতাকেও তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। যে জগৎ জীবন ও মৃত্যুর সীমায় আবদ্ধ এবং যে জগৎ ইন্দ্রিয়গোচর ও যুক্তিগ্রাহ্য, সেই জগৎকেন্দ্রিক মানবজীবনের সাধনাই হলো ইহজাগতিকতা। মানুষকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা ও ধ্যান-ধারণাই ইহজাগতিকতার প্রধান লক্ষণ। এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জিত হয়েছিল ইতালীয় রেনেসাঁসের আবির্ভাবের কারণে।


ভারতীয় উপমহাদেশে নবজাগরণ ঘটেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। সেই জাগরণ বা রেনেসাঁস ছিল খণ্ডিত। বৃহৎ মুসলমান সমাজকে সেই রেনেসাঁস স্পর্শ করেনি। মূলত হিন্দু মধ্যবিত্তের বিকাশ সাধিত হয়েছিল তখন। রাজা রামমোহন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত, মাইকেল, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ প্রমুখ ছিলেন এই নবজাগরণের অগ্রদূত। তাঁদের সাবলীল রচনায়, বিতর্কে ও তৎপরতায় শাণিত হয়ে উঠেছিল সেই সময়ের চিন্তাধারা।


বাঙালি মুসলমান সমাজে মুক্তবুদ্ধির প্রসারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত। তখন ঢাকায় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ গড়ে ওঠে মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতৃত্বে। কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজলের মতো মুক্তচিন্তার বাহকেরা ছিলেন এই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁদের একটি মুখপত্র বের হতো শিখা নামে। এর প্রতিটি সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা থাকত, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’।


তৎকালীন পূর্ব বাংলা তখন তৈরি হচ্ছিল এক নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে। এ ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সমবয়সী কবীর চৌধুরীর জীবনের পূর্বাপর বিশ্লেষণ করতে গেলে ওপরোক্ত প্রেক্ষাপট মনে রাখা জরুরি।


অনন্যসাধারণ শিক্ষাজীবনের অধিকারী কবীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের মিনোসেটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্য এবং সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসন বিষয়ে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।


তাঁর কর্মজীবনও ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, শিক্ষাসচিব, বাংলা একাডেমির সেই সময়ের সর্বোচ্চ পদ পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেখক হিসেবে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন।
সাহিত্যিক কবীর চৌধুরীর সবচেয়ে বড় ভূমিকা অনুবাদক হিসেবে। বিশ্বসাহিত্য ও শিল্পকলার সঙ্গে এ দেশের পাঠকের সেতু গড়েছেন তিনি। বিশ্বের সেরা সাহিত্যকর্মের প্রাঞ্জল অনুবাদ বাংলাভাষী পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। প্রবন্ধচর্চার ক্ষেত্র হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিত্রকলা, সমাজ ও রাজনীতিকে। তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল উদার মানবতাবাদী, প্রগতিশীল ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। প্রাবন্ধিক ও সমালোচক হিসেবে তিনি ছিলেন মুক্তমনা, যুক্তিনিষ্ঠ ও বিজ্ঞানমনস্ক। রেনেসাঁসের তীব্র অনুরাগী কবীর চৌধুরীর জীবনদর্শন স্পষ্ট হয় ‘মুক্তবুদ্ধির চর্চা’ প্রবন্ধে, ‘অন্ধবিশ্বাস নয়, কূপমণ্ডূকতা নয়, গতানুগতিকের নির্বোধ পুনরাবৃত্তি নয় এবং চোখ-কান খোলা রেখে জীবন ও জগৎকে দেখা, সুন্দরের আবিষ্কার, মানুষের ক্ষমতা ও প্রতিভার পরিচয় লাভ করে আত্মবিশ্বাস ও গৌরববোধের স্ফুরণ…এ সবই প্রধান হয়ে ওঠে ইউরোপীয় রেনেসাঁস আন্দোলনে।’ এই রেনেসাঁসেরই উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন কবীর চৌধুরী। তিনি বাংলার রেনেসাঁসের প্রবক্তা রামমোহন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত ও রবীন্দ্রনাথের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। নজরুল, বেগম রোকেয়া, ‘শিখা’ গোষ্ঠী তথা মুসলিম সমাজে নবজাগরণ সৃষ্টিকারী মনীষীদের অবদানকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন তিনি।


মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছিলেন কবীর চৌধুরী। অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে ও ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তিনি নির্ভীক ভূমিকা পালন করেছেন। কোনো হুমকির মুখে তিনি বিচলিত হননি। এ ক্ষেত্রে তিনি দুইভাবে কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। সচেতনতামূলক প্রবন্ধ ও বই লিখে এবং সাংগঠনিকভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে। যথার্থ সমাজবিজ্ঞানীর মতোই তিনি সমাজদেহের দুষ্টক্ষতকে শনাক্ত করে নিরাময়ের উপায় নির্দেশ করেছিলেন, ‘মানবধর্মকে উপেক্ষা করে শুধু সম্প্রদায়ভিত্তিক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করলে মানুষ আর যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠে না, তখন আর আমরা মানুষের জন্য ধর্মের কথা ভাবি না, ভাবি যে ধর্মের জন্যই বুঝি মানুষ। বর্তমান বাংলাদেশের দুঃসময়ে সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত করা অত্যাবশ্যক।’ ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির শক্তিতে অত্যন্ত আস্থাবান ছিলেন কবীর চৌধুরী। দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন, ‘আমাদের বাঙালিত্বকে আশ্রয় করেই আমরা নিজেদের বিকশিত করে তুলব। এ কাজে আমাদের গৌরবদীপ্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যই অন্যতম হাতিয়ার হবে, গতানুগতিক কোনো ধর্মীয় চেতনা নয়।’


কবীর চৌধুরী নিজে যেমন উদার, প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী মনীষী ছিলেন, তেমনি এই ধারার ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি যোগদান করেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের একান্ত অনুগত গভর্নর মোনায়েম খানের নিজের শহর ছিল ময়মনসিংহ। মুক্তবুদ্ধির ধারক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যক্তিদের জন্য এটি ছিল চরম দুঃসময়। কবীর চৌধুরী সমমনা কয়েকজন লেখক-বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ময়মনসিংহে সাহিত্যচক্র গড়ে তোলেন। এ প্রসঙ্গে একটি স্মৃতিচারণামূলক লেখায় এসব সাহিত্য আসর সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘ওই সব আসরে স্বরচিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ পড়া হতো, আলোচকেরা সেসব রচনার গুণাগুণ বিশ্লেষণ করতেন। সর্বদাই ঝোঁক থাকত উদার মানবিকতার বিকাশের দিকে এবং ধর্মান্ধ মৌলবাদী একগুঁয়ে ভাবধারাকে প্রতিহত করার ও এই ধারার আলোচনা সভাগুলোয় যতীন সরকার সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। তাঁর জন্য কাজটা সহজ ছিল না। তিনি ছিলেন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য…তিনি যে ধর্মগতভাবে একজন হিন্দু, আইয়ুব-মোনায়েমের আমলে সন্দেহ ও বৈরিতার চোখে দেখার জন্য তা–ই ছিল যথেষ্ট। …প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় ছিল, আমার সম্পর্কে তাঁরা সবিশেষ অবহিত ছিলেন এবং তাঁরা স্থির করেন যে আমি যদি যতীন সরকারের দিকে আমার স্নেহ ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই, তাহলে ওই লোকটিকে হয়রানি করা ঠিক হবে না।’


শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের ক্ষেত্রে কবীর চৌধুরী অভিভাবকতুল্য ভূমিকা পালন করেছেন। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও মুক্তচিন্তা, উদার মানবতাবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে উগ্রবাদ। এই সংকটে বিবেকবান মুক্তচিন্তক কবীর চৌধুরীর উজ্জ্বল রেনেসাঁস চেতনা আমাদের পথ নির্দেশ করতে পারে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *