মুহাম্মদ জিয়াউল হক
সৃষ্টিকুলের সব অনুপম সৌন্দর্যের আধার হযরত রাসুল (সা.)-এর দৈহিক সৌন্দর্যের বিবরণ মুখে বলে কিংবা কলমে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে এমন কোনো পুষ্পিত শব্দ নেই, যা তাঁর নিপুণ দেহের শৈল্পিক কাঠামো সামগ্রিক চিত্রায়ণে চিত্রিত করতে পারে। হযরত রাসুল (সা.)-এর দেহকান্তি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন-সৌষ্ঠব কাছাকাছি কোনো চিত্রেও অঙ্কিত করা সম্ভব নয়। দেহের সৌন্দর্য ও লাবণ্যময়তা ফুটে ওঠে যখন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও তার কারুকর্ম নিখুঁত ও সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
বারা ইবনে আজেব (রা.) বলেন, হযরত রাসুল (সা.) মধ্যম গড়নের ছিলেন। তাঁর উভয় বাহুমূলের মধ্যবর্তী স্থান অন্যদের তুলনায় কিছুটা প্রশস্ত ছিল। তাঁর মাথার ঘন কেশরাশি উভয় কানের লতি পর্যন্ত প্রলম্বিত ছিল। তাঁর পরনে ছিল লাল (ডোরা কাটা) চাদর ও লুঙ্গি। আমি তাঁর চেয়ে বেশি সুন্দর কিছু দেখিনি। অন্য বর্ণনায় আছে, ‘রাসুল (সা.) ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর চেহারার অধিকারী, সর্বোত্তম চরিত্রবান। অতিকায় লম্বাও না, বেঁটেও না। অন্য হাদিসে এসেছে, চাদর ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় বাবরিচুলবিশিষ্ট কোনো লোককে রাসুল (সা.)-এর চেয়ে বেশি সুদর্শন দেখিনি। তাঁর বাবরিচুল কাঁধ ছুঁই ছুঁই করত। অপর বর্ণনায় বারা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, রাসুল (সা.)-এর চেহারা মোবারক কি তলোয়ারের মতো? তিনি জবাবে বলেন, ‘চাঁদের মতো।’ (বুখারি, হাদিস: ৩৫৪৯, ৩৫৫১)
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) অতি লম্বা ছিলেন না। আবার বেঁটেও ছিলেন না (মাঝারি গঠনের চেয়ে ঈষৎ লম্বা ছিলেন)। তিনি ধবধবে সাদা ছিলেন না। আবার সম্পূর্ণ তামাটে (গোধুম) বর্ণেরও ছিলেন না (পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে উজ্জ্বল লাবণ্যময় ছিলেন)। তাঁর মাথার চুল একেবারে কুঞ্চিত ছিল না। একেবারে সোজাও ছিল না (বরং ঈষৎ কোঁকড়ানো ঢেউ খেলানো ছিল)। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘রাসুল (সা.)-এর উভয় হাত ও পা ছিল মাংসল। চেহারা ছিল সুদর্শন। হাতের তালু ছিল প্রশস্ত। আমি আগে-পরে তাঁর মতো কাউকে দেখিনি। (বুখারি, হাদিস: ৫৯০০, ৫৯০৭)
আবু তুফাইল (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) সাদা-লাল মিশ্রিত অতিশয় সুন্দর রক্তিমাভ ছিলেন। লাবণ্যময়, সুষম দেহকান্তির অধিকারী ছিলেন। (মুসলিম, হাদিস: ২৩৪০)
শুবা (রা.) থেকে বর্ণিত, সামাক বিন হরব (রহ.) বলেন, ‘আমি জাবের ইবনে সামুরার কাছে শুনেছি, ‘রাসুল (সা.)-এর মুখাবয়ব ছিল কিছুটা প্রশস্ত। চোখের শুভ্রতার মধ্যে রক্তিম রেখা টানা ছিল। পায়ের গোড়ালি হালকা ও কম গোশতবিশিষ্ট ছিল।’ (মুসলিম, হাদিস: ২৩৩৯)
জাবের ইবনে সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.)-এর মাথার অগ্রভাগের চুল ও দাড়ি মোবারক সাদা কালো মিশ্রিত ছিল। তেল ব্যবহার করলে ঝকঝক করত না। চুলগুলো যখন এলোমেলো থাকত, তখন ঝকঝক করত। তাঁর দাড়িতে চুল ছিল অনেক। তখন একজন বলল, ‘তাঁর চেহারা কি তলোয়ারের মতো চকচকে ছিল? তিনি বললেন, না, বরং চাঁদ-সূর্যের মতো ছিল। ছিল উজ্জ্বল ও গোলাকৃতির। তাঁর স্কন্ধদেশে মোহরে নবুয়ত দেখেছি কবুতরের ডিমের মতো; তাঁর শরীরের বর্ণেই। (মুসলিম, হাদিস: ২৩৪৪)
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আমি রাসুল (সা.)-এর হাতের তালুর মতো কোমল কোনো রেশম স্পর্শ করিনি। রাসুল (সা.)-এর শরীরের ঘ্রাণের চেয়ে উত্তম কোনো সুঘ্রাণ অনুভব করিনি। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) ছিলেন অতিশয় উজ্জ্বল। তাঁর ঘাম যেন মুক্তার মতো চকচক করছে। তিনি হাঁটার সময় সামনের দিকে একটু ঝুঁকে হাঁটতেন। (বুখারি, হাদিস: ৩৫৬৯)
জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, ‘আমি তাঁর হাত ধরে এমন আর্দ্রতা ও সুঘ্রাণ অনুভব করেছি, মনে হয়েছে তিনি তা সুগন্ধির কস্তুরি থেকে বের করেছেন। ’ (মুসলিম, হাদিস: ২৩২৯)
হাদিসগুলোর সারসংক্ষেপ আমরা যা দেখতে পাই, তা হলো, রাসুল (সা.)-এর দেহাবয়ব ও সৌন্দর্য বিবরণীর সব হাদিস থেকে দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে- ১. সর্বোপরি সুষমতা ও সাম্যতা। ২. শরীরের প্রতিটি অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের সামাঞ্জস্যপূর্ণতা। এটা এরই মধ্যে বর্ণিত হাদিসগুলো থেকেই প্রতীয়মান হয়েছে।
তিনি দেহদৈর্ঘ্যে মাঝারি আকৃতির ছিলেন। অতিকায় লম্বা বা বেঁটে ছিলেন না। বর্ণের দিক থেকে তিনি ছিলেন দ্বীপ্তিময় বর্ণের। তাঁর চুল সোজাও ছিল না, আবার জটের মতো কোঁকড়ানোও ছিল না। শরীরের সব অঙ্গের মাঝে যখন সামাঞ্জস্যতা ফুটে ওঠে, দেহের সৌন্দর্যের পূর্ণতা বুঝে আসে। এর আগে সব হাদিস দ্বারা এ বিষয়টিই ফুটে উঠেছে। উভয় বাহুর মধ্যবর্তী স্থানের প্রশস্ততা, উভয় হাত ও পায়ের মাংসল গঠন দেহসৌন্দর্যে কোনো ত্রুটি নয়; বরং সব হাদিস একত্র করলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাঝে সমন্বয় সাধিত হয়। তিনি অত্যন্ত স্থ্থূল ছিলেন না। একেবারে শীর্ণকায়ও না। বক্ষ ছিল কিছুটা উঁচু বীর বাহাদুরের মতো প্রশস্ত। বক্ষস্থল থেকে নাভি পর্যন্ত চুলের সরু রেখা ছিল।
মোটকথা সব ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক ও মধ্যমরূপী। যার ফলে রাসুল (সা.)-এর দেহ মোবারকের পরিপূর্ণতা ও সুষম পৌরুষ ফুটে উঠেছে। একজন মহাপুরুষের যাবতীয় লক্ষণ পূর্ণমাত্রায় রাসুল (সা.)-এর ব্যক্তি ও দেহসত্তায় বিদ্যমান ছিল। নবিজি (সা.)-কে দেখলে যেকোনো মানুষের অন্তর প্রভাবিত হতো।