জয়শ্রী ভাদুড়ী: বড়ভাই সুমন শেখের (৩২) চেয়ে মাত্র দুই বছরের ছোট সুজন শেখ (৩০)। কর্নিয়াজনিত অন্ধত্বের শিকার সুমন। ভাইয়ের চোখের আলো ফেরাতে হাসপাতাল থেকে শুরু করে চিকিৎসকের দুয়ারে ঘুরতেন সুজন। সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মরণোত্তর চক্ষুদানে আগ্রহ জানান সুমন। পরিবারের কাছে বলে যান, তিনি মারা গেলে তার ভাই এবং অন্য এক অন্ধ ব্যক্তিকে যেন তার কর্নিয়া দুটি দেওয়া হয়। তাদের চোখে আলো ফেরানোই ছিল সুমনের শেষ ইচ্ছা। সুমনের ভাই সুজন শেখ বলেন, ‘চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার ভাই মারা গেলে সন্ধানী তার কর্নিয়া সংগ্রহ করে আমার এবং আরেক অন্ধ ব্যক্তির চোখে প্রতিস্থাপন করে। ভাইয়ের দেওয়া চক্ষু দিয়ে এখন আমি সবকিছু দেখতে পারি।’
মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে মানুষের মাঝে জানাশোনা কম। অনেকে মনে করে চোখ তুলে নেওয়া হয়। আসলে এরকম কিছু না। পাতলা লেন্সের মতো দেখতে চোখের কর্নিয়া সংগ্রহ করে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা দেশে বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। দেশে প্রায় ৫ লাখ মানুষ কর্নিয়াজনিত চোখের সমস্যায় ভুগছে। সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, রোটারি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে আগ্রহ বাড়ছে মরণোত্তর চক্ষুদানে। রাজধানীর নীলক্ষেতে সন্ধানী চক্ষু হাসপাতাল কিংবা বিএসএমএমইউর সি ব্ল¬কের সাত তলায় চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগে মরণোত্তর চক্ষুদানে আগ্রহী হয়ে নিবন্ধন করছেন অনেকেই।
সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি সূত্রে জানা যায়, দেশে অন্ধত্বের হার ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ কর্নিয়াজনিত অন্ধত্বের শিকার। দেশে কর্নিয়াজনিত অন্ধের সংখ্যা ৫ লাখের বেশি, যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার ব্যক্তি নতুন করে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্বের শিকার হয়। সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মণিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে শ্রীলঙ্কার ডা. হাডসন ডি সিলভা ১৯৮৪ সালের ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশে এসেছিলেন একজোড়া কর্নিয়া নিয়ে। রংপুরের অন্ধ কিশোরী টুনটুনির দুই চোখে সেগুলো স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে জন্ম হয়েছিল সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির। টুনটুনির চোখে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটাই দেশে প্রথম কর্নিয়া প্রতিস্থাপন। সন্ধানী এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দক্ষ চিকিৎসক, অত্যাধুনিক হাসপাতাল থাকার পরও কর্নিয়া সংগ্রহ কম হওয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। মরণোত্তর চক্ষুদানে আগ্রহী বাড়াতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মিথ্যা কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে এলে আলো ফুটবে অসংখ্য অন্ধ মানুষের চোখে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (কর্নিয়া) ডা. রাজশ্রী দাশ বলেন, ‘গত এক বছরে বিএসএমএমইউতে ২৯টি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে সারাহ ইসলাম ও নন্দিতা বড়ুয়া মরণোত্তর চক্ষু দান করেছেন। এছাড়া নেপাল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কর্নিয়া এনেও অপারেশন করা হয়েছে। অন্য দেশ থেকে কর্নিয়া আনতে শুধু সংরক্ষণ খরচ বহন করতে হয়। তারও সর্বনিম্ন খরচ ৩৫০ মার্কিন ডলার; যা বেশ ব্যয়বহুল। আমাদের দেশের তরুণরা এগিয়ে এলে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করলে মরণোত্তর চক্ষুদান কর্মসূচি আরও বেগবান হতো। কুসংস্কার এবং প্রচারের অভাবের কারণে আমরা কাঙিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছি না।’