দেওয়ানবাগ ডেস্ক: ব্যাংক খাতে আমানত বাড়তে শুরু করেছে। ব্যাংক থেকে আগে তুলে নেওয়া টাকা আবার ব্যাংকে জমা হচ্ছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, অধিকাংশ ব্যাংকেরই আমানত ফিরতে শুরু করেছে। তারা বলছেন নভেম্বরের চেয়ে ডিসেম্বরে বেশি আমানত পেয়েছে ব্যাংকগুলো। ডিসেম্বরের চেয়ে জানুয়ারি মাসে আরও বেড়েছে। একইভাবে জানুয়ারি মাসের চেয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে আরও বেড়েছে আমানত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বরে ব্যাংক ব্যবস্থায় আমানত বেড়েছে ২ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। এর আগের মাসে নভেম্বরে ব্যাংক আমানত ছিল ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। অবশ্য অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে আমানত কমেছিল ৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। গত অক্টোবরে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯০ হাজার ৪৩ কোটি টাকা।
গত ১৫ জানুয়ারি ৬ শতাংশ বেঁধে দেওয়া আমানতের সুদ হারের সীমা তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে সুদহার ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
এর সুফলও মিলছে। ইতোমধ্যে আমানতের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। আর সুদের হার বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোতে আমানতও বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণের সুদ বাড়লে আমানতের সুদ হার বেড়ে যায়। আর আমানতের সুদ হার বাড়লে স্বস্তি পান সুদ আয় নির্ভর আমানতকারীরা।
২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ ছয় মাসের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ব্যাংকের আমানতের ওপর বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় আমানতের সর্বনি¤œ সুদহার পুরোপুরি তুলে নেওয়া হলো। এছাড়া নতুন মুদ্রানীতিতে ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়ানোরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে সুদহার ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। অর্থাৎ ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়িয়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত করতে পারবে ব্যাংকগুলো।
নতুন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আমানতের সুদহার উন্মুক্ত করে দেওয়া ও ঋণ সুদহারে কিছুটা শিথিল করায় তা আমানতের সুদহার বাড়াতে সহায়তা করবে।
যদিও দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই মানুষের সঞ্চয়ের ক্ষমতা কমেছে। অনেকে জমানো টাকা তুলে সংসার চালাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন অনিয়মের খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে টাকা তুলে রাখার প্রবণতা তৈরি হয়। এ অবস্থায় আমানতের সুদহার বাড়াচ্ছে অনেক ব্যাংক। ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা বহালের মধ্যে আমানতে ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে কোনও কোনও ব্যাংক।
বর্তমানে গড় মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কাছাকাছি। এর কম সুদ দেওয়া মানে প্রকৃতপক্ষে আমানতকারীর লোকসান। এসব কারণে সুদহারের ৯ শতাংশ সীমা বহাল থাকলেও আমানতের সুদ বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো।
প্রসঙ্গত, কোন ব্যাংক কত সুদে আমানত নিচ্ছে প্রতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তা ঘোষণা দিতে হয়। সুদহার বাড়ালে বা কমালে নিজ ব্যাংকের ওয়েবসাইটেও নোটিশ দিতে হয়।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের এপ্রিলে ঋণের সুদহার ৯ ও আমানতের সুদ হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে ৮ শতাংশ সুদে আমানত নেওয়া শুরু করেছে পদ্মা ব্যাংক। এছাড়া বেসরকারি খাতের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক মেয়াদি আমানতে ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। আগের মাসে যা ছিল সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ শতাংশ।
বেসরকারি এক্সিম ব্যাংক জানুয়ারিতে মুনাফার হার সাড়ে ৭ শতাংশ করেছে। আগের মাসে যা ছিল সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ। এবি ব্যাংক জানুয়ারিতে মেয়াদি আমানতে সুদহার ঘোষণা করেছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। আগের মাসেও যা সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ ছিল। আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ করেছে। গত ডিসেম্বরে সাড়ে ৬ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নেওয়া রূপালী ব্যাংক এখন সুদ দিচ্ছে ৭ শতাংশ। জনতা ব্যাংকও ৭ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির আমানতে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আমানতে সুদ হার ৭ শতাংশ করেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।
অবশ্য ডিসেম্বর প্রান্তিকের তথ্য বলছে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর মাসে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। এক বছর আগে যা ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই তথ্য বলছে সুদহার বাড়লেও আমানত প্রবৃদ্ধি সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমেছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে আমানত ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়ে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা হয়েছে। অথচ এক বছরে ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ ঋণ বেড়ে ডিসেম্বর শেষে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যাংকগুলোতে এখন টাকার সংকট চলছে। আমানত পেতে হলে সুদ বাড়াতে হবে। সুদ না বাড়িয়ে উপায় নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশে ওঠে আমানতের প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ইতিহাসে এ যাবৎকালের সর্বনি¤œ প্রবৃদ্ধি। এর আগে ২০১৮ সালের এপ্রিলে ব্যাংকগুলোর আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে।
প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরই সবচেয়ে কম বেড়েছে আমানত। করোনা মহামারির বছর ২০২০ সালে ব্যাংক খাতে আমানত বাড়ে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সাড়ে ১৩ শতাংশ। তার পরের বছর ২০২১ সালে আমানত বেড়েছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ২১ শতাংশ। আর গত বছর বেড়েছে ৭৯ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)-এর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, যারা ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে নিয়ে বাসায় রেখেছিলেন, তারা আবার টাকা ব্যাংকে রাখা শুরু করেছে। বিভিন্ন অপপ্রচারের কারণে ভয়ে অনেকেই টাকা উঠিয়ে নেওয়ার পর যখন দেখলো ব্যাংকগুলোকে চেক দিলে সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দিচ্ছে। কর্মকর্তাদের নিয়মিত বেতন হচ্ছে। সবগুলো ব্যাংকে ঠিকমত লেনদেন হচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাংকের প্রতি আস্থা বেড়ে যাওয়ায় সবাই আবার ব্যাংকে আসা শুরু করেছে। এছাড়া বাসায় টাকা রাখা রিস্কি এ কারণে ব্যাংক থেকে উঠিয়ে নেওয়া টাকা আবার ব্যাংকে রাখা শুরু করেছেন। এ কারণে ব্যাংক খাতে আমানত বাড়ছে।