বিশ্বনবির জন্মস্থান মক্কা নগরী

বিশ্বনবির জন্মস্থান মক্কা নগরী

শামসীর হারুনুর রশীদ
মক্কা শব্দের ব্যুৎপত্তি ও ভৌগলিক অবস্থান: পবিত্র মক্কা মুকাররমা আল্লাহর নিরাপদ নগরীর নাম। ‘মক্কা’ সেমিটিক ভাষা ‘বাক্কা’ থেকে উৎকলিত, যার অর্থ উপত্যকা। পবিত্র কুরআনের এক জায়গায় মক্কার নাম ‘বাক্কা’ বলে উল্লিখিত হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয় প্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছে, তা বাক্কায় (মক্কায়) যা বরকতময় ও হিদায়েত বিশ্ববাসীর জন্য। (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৯৬) ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী এখানে প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করেন। সৌদি আরবের হেজাজের সমুদ্রতল থেকে ২৭৭ মিটার (৯০৯ ফুট) ওপরে একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় শহরটি অবস্থিত।
এ শহরে হযরত মোহাম্মদ (সা.) ২০ এপ্রিল ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং এখানেই তিনি কুরআনের প্রথম ওহি লাভ করেন। মক্কার প্রাণকেন্দ্রে ‘কাবা’ অবস্থিত। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী কাবা হলো পৃথিবীর প্রথম মসজিদ। ১৯২৫ সালে ইবনু সৌদ-এর মাধ্যমে সৌদি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সৌদ বংশ মক্কার দায়িত্ব লাভ করে। বর্তমানেও এ রাজবংশ মক্কা শাসন করছে। (আরব জাতির ইতিহাসচর্চা, একেএম ইয়াকুব আলী: ৪০-৭০)
নগর প্রতিষ্ঠা ও ইবরাহিম (আ.)-এর আগমন
খ্রিষ্টপূর্ব ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর যুগ থেকে মক্কার ইতিহাস শুরু হয়; ইবরাহিম (আ.) মিসর থেকে ফিরে কেন ‘আনে আসার বছরাধিককাল পর প্রথম সন্তান ইসমাইলের জন্ম লাভ হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তিনি শিশুসন্তান ও তার মা হাজেরাকে মক্কার বিজন পাহাড়ি উপত্যকায় নিঃসঙ্গভাবে রেখে আসার এলাহি নির্দেশ লাভ করেন। বস্তুত এটা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক পরীক্ষা।
এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নরূপ-হযরত ইবরাহিম (আ.) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.) ও তাঁর মাকে মক্কায় নির্বাসনে রেখে আসার নির্দেশ পান, তখনই তার অন্তরে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, নিশ্চয়ই এ নির্দেশের মধ্যে আল্লাহর কোনো মহতি পরিকল্পনা লুকায়িত আছে এবং নিশ্চয়ই তিনি ইসমাইল ও তার মাকে ধ্বংস করবেন না। অতঃপর এক থলে খেজুর ও এক মশক পানিসহ তাদের বিজন ভূমিতে রেখে যখন ইবরাহিম (আ.) একাকী ফিরে আসতে থাকেন, তখন বেদনা-বিস্মিত স্ত্রী হাজেরা ব্যাকুলভাবে তার পিছে পিছে আসতে থাকেন আর স্বামীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে থাকেন। কিন্তু বুকে বেদনার পাষাণ বাঁধা ইবরাহিমের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না।
তখন হাজেরা বললেন, আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদের এভাবে ফেলে যাচ্ছেন? ইবরাহিম ইশারায় বললেন, হ্যাঁ। তখন স্বস্তির সাড়া পেয়ে অটল বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে হাজেরা বলে ওঠেন, ‘তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না’। ফিরে এলেন তিনি সন্তানের কাছে। দু-একদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে পানি ও খেজুর। কী হবে উপায়? খাদ্য ও পানি বিহনে বুকের দুধ শুকিয়ে গেলে কচি বাচ্চা কী খেয়ে বাঁচবে? পাগলপারা হয়ে তিনি মানুষের সন্ধানে দৌড়াতে থাকেন ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ের এমাথা আর ওমাথায়।
এভাবে সপ্তমবারে তিনি দূর থেকে দেখেন যে, বাচ্চার পায়ের কাছ থেকে মাটির বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ঝরনার ফল্গুধারা, জিবরাইলের পায়ের গোড়ালি বা তার পাখার আঘাতে যা সৃষ্টি হয়েছিল। ছুটে এসে বাচ্চাকে কোলে নিলেন অসীম মমতায়। স্নিগ্ধ পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। হঠাৎ অদূরে একটি আওয়াজ শুনে তিনি চমকে উঠলেন। তিনি জিবরাইল (আ.) বলে উঠলেন, ‘আপনারা ভয় পাবেন না, এখানেই আল্লাহর ঘর। এই সন্তান ও তার পিতা এ ঘর সত্বর পুনঃনির্মাণ করবেন। আল্লাহ তাঁর ঘরের বাসিন্দাদের ধ্বংস করবেন না’ বলেই শব্দ মিলিয়ে গেল। (তাফসিরে ইবনে কাছির বাংলা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৮১-৮৩)
অতঃপর শুরু হলো ইসমাইলি জীবনের নব অধ্যায়। পানি দেখে পাখি এলো। পাখি ওড়া দেখে ব্যবসায়ী কাফেলা এলো। তারা এসে পানির মালিক হিসাবে হাজেরার কাছে অনুমতি চাইলে তিনি এই শর্তে মনজুর করলেন যে, আপনাদের এখানে বসতি স্থাপন করতে হবে। বিনা পয়সায় এ প্রস্তাব তারা সাগ্রহে কবুল করল। এরাই হলো ইয়ামন থেকে আগত বনু জুরহুম গোত্র। বড় হয়ে ইসমাইল (আ.) এই গোত্রে বিয়ে করেন।
এরাই কাবা গৃহের খাদেম হন এবং এদের শাখা গোত্র কুরাইশ বংশে শেষ নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমন ঘটে। ওদিকে ইবরাহিম (আ.) যখন স্ত্রী ও সন্তান রেখে যান তখন হাজেরার দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এই বলে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি আমার পরিবারের কিছু সদস্যকে তোমার মর্যাদামণ্ডিত গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি। প্রভু হে! যাতে তারা সালাত কায়েম করে। অতএব, কিছু লোকের অন্তরকে তুমি এদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদের ফল-ফলাদি দ্বারা রিজিক দান কর। সম্ভবত তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।’ (সূরা ইবরাহিম: আয়াত ৩৭)

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *