কাসেম শরীফ: মহানবি (সা.)-এর একাধিক নাম আছে। তাঁর অন্যতম নাম আহমাদ। জুবাইর ইবনে মুতয়িম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার পাঁচটি (প্রসিদ্ধ) নাম আছে, আমি মোহাম্মাদ, আমি আহমাদ, আমি আল-মাহি (আমার দ্বারা আল্লাহ্ কুফর ও শিরককে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন)। আমি আল-হাশির (আমার চারপাশে মানবজাতিকে একত্রিত করা হবে)। আমি আল-আকিব (সর্বশেষে আগমনকারী)। (বুখারি শরীফ, হাদিস : ৩৫৩২)
আহমাদ শব্দের অর্থ দুটি। এক. মোহাম্মদ শব্দের সমার্থক অর্থাৎ বেশি প্রশংসিত। অন্য অর্থ হলো বেশি প্রশংসাকারী। যেহেতু নবি (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে বেশি প্রশংসিত এবং মানুষের কাছে, ফেরেশতাদের কাছে তিনি সমাদৃত আর বিভিন্ন প্রশংসিত গুণাবলি তাঁর মধ্যে বিদ্যমান, তাই তাকে মোহাম্মদ ও আহমাদ বলা হয়।
দাদা আবদুল মুত্তালিব (আ.) প্রিয় নবি (সা.)-এর নাম রাখেন ‘মোহাম্মাদ’। এই নাম শুনে লোকেরা নাম রাখার কারণ জিজ্ঞেস করে। তিনি বলেন, আমি চাই, আমার সন্তান সারা দুনিয়ায় ‘প্রশংসিত’ হোক। (রাহমাতুল্লিল আলামিন: ১/৪১) আর আহমাদ নাম রাখেন মা আমেনা। স্বপ্নের মাধ্যমে ফেরেশতার দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী মা আমেনা তাঁর নাম রাখেন ‘আহমাদ’ (রাহমাতুল্লিল আলামিন: ১/৩৯)
আহমাদ নাম প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘স্মরণ করো, মারইয়াম পুত্র ঈসা বলেছিল, হে বনি ইসরাঈল, আমি তোমাদের কাছে (প্রেরিত) আল্লাহর রাসুল এবং আমার আগ থেকে তোমাদের কাছে যে তাওরাত এসেছে, আমি তার সমর্থক। আর আমার পরে আহমাদ নামে যে রাসুল আসবেন আমি তার সুসংবাদদাতা…।’ (সূরা সাফফ: আয়াত ৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আহমাদ নামের গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য হলো- এক. আহমাদ নাম আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত নাম। দুই. এই নামে তিনি ফেরেশতাকুল তথা আসমানবাসীর কাছে পরিচিত। তিন. আগের আসমানি কিতাবে তিনি এই নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। চার. কিয়ামতের আগে দাজ্জালের আবির্ভাব এই আহমাদ নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ঈসা (আ.)-এর আগমন এই আহমাদ নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং ইমাম মাহদির আগমন এই নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটি সহিহ হাদিসে এ বিষয়ে ইঙ্গিত আছে। মুহজিন বিন আদরা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, মুক্তির দিন, মুক্তির দিন কী? মুক্তির দিন, মুক্তির দিন কী? মুক্তির দিন, মুক্তির দিন কী? অতঃপর তাঁকে বলা হলো, মুক্তির দিন কী? তিনি বলেন, (একদিন) দাজ্জাল আসবে। সে ওহুদ পাহাড়ে আরোহণ করবে (এবং মদিনা দেখতে পাবে)। সে তার সঙ্গীদের বলবে, তোমরা কি এই সাদা প্রাসাদ দেখছ? এটি আহমাদ (সা.)-এর মসজিদ এবং মদিনার সন্নিকটে আসবে। মদিনার প্রত্যেকটি প্রবেশপথে সে ফেরেশতাদের সারিবদ্ধভাবে পাহারায় নিয়োজিত দেখতে পাবে। অতঃপর সে (মদিনার অদূরে) জুরুফ-এর অনুর্বর জমিতে নেমে আসবে এবং মদিনা শহরের তোরণ ধরে আঘাত করবে। অতঃপর মদিনা তিনবার কেঁপে উঠবে। তখন মদিনা থেকে সব মুুনাফিক নর-নারী, পাপাচারী নর-নারী বের হয়ে যাবে। সেদিনটিই মুক্তির দিন। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৩/৩১১; মুসতাদরাক হাকিম ও মুসনাদ আহমাদ) ইমাম জাহাবি (রহ.) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।
এই হাদিসের মূল বক্তব্য সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮১ এবং সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭২৮১ এর মধ্যে বিবৃত হয়েছে। যদিও সেগুলোতে আহমাদ নামের কথা উল্লেখ নেই।
পাঁচ. আহমাদ নামের আরো একটি তাৎপর্য হলো, এই নাম পৃথিবীতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগে আর নাম ছিল না। যদিও মোহাম্মাদ নাম আগে ছিল কি না-এ বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। আহমাদ নাম প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, আমাকে এমন জিনিস দান করা হয়েছে, যা আমার আগে অন্য কোনো নবিদের দেওয়া হয়নি। আমরা (সাহাবারা) বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, সেগুলো কী? তিনি বললেন, আমাকে বিরল প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। আমাকে পৃথিবীর ধনভাণ্ডার দেওয়া হয়েছে। আর আমার নাম আহমাদ রাখা হয়েছে, পুরো জমিনকে আমার জন্য পবিত্রতা অর্জনের উপায় করা হয়েছে আর আমার উম্মতকে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত বানানো হয়েছে। (সিলসিলা সহিহাহ, হাদিস: ৩৯৩৯)
মোহাম্মাদ ও আহমাদ নামের মধ্যে পার্থক্য
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) লিখেছেন, মোহাম্মাদ ও আহমাদ নামের মধ্যে দুটি পার্থক্য আছে-
১. মোহাম্মাদ শব্দের মধ্যে একের পর এক প্রশংসিত হওয়ার অর্থ আছে। অর্থাৎ সেখানে প্রশংসার আধিক্য আছে। সেই অর্থে এটি সংখ্যা বা কোয়ান্টিটিতে প্রশংসাজ্ঞাপক। আর আহমাদ আরবি ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী ইসম তাফদিল। এর মধ্যে প্রশংসা করার ক্ষেত্রে প্রাধান্য ও কোয়ালিটির কথা আছে।
২. মোহাম্মাদ মানে বারবার প্রশংসাপ্রাপ্ত। আর আহমাদ মানে আল্লাহর সবচেয়ে বেশি প্রশংসাকারী। (জালাউল আফহাম, পৃষ্ঠা ২৯৯)