(বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে নির্মিত ‘বিলিয়ন ডলার হেইস্ট’ ডকুমেন্টারি অবলম্বনে লিখিত)
দেওয়ানবাগ ডেস্ক: ৫ই ফেব্রæয়ারী ২০১৬। ঢাকার বাংলাদেশ ব্যাংক হেডকোয়ার্টার। শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটি ও জুমার দিন। অফিসে শুধু অল্পসংখ্যক কর্মী উপস্থিত। তাদের মধ্যে একজন জোবায়ের বিন হুদা, ডেপুটি ম্যানেজার। যে কজন বিশেষ ব্যক্তি বাংলাদেশ ব্যাংকে সুইফট ব্যাংকিং সিস্টেমে কাজ করেন, জোবায়ের তাদের একজন।
সারা দুনিয়ার ব্যংকগুলোর মধ্যে লেনদেনের জন্য সর্বাধুনিক ও নিরাপদ যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেটি হল সুইফট ব্যবস্থা। প্রতিদিনের মতই হুদা সুইফট প্রিন্টারের কাছে গেলেন, যেটিতে আগের দিনের সকল লেনদেনের লেজার প্রিন্ট হয়। সাধারণত আগের রাতে যে সকল লেনদেন হয়েছে, সেগুলোর প্রিন্ট আউট বের হয়। সুইফট সফটওয়্যার প্রতিদিন যেসব লেনদেন হয়, পরবর্তীতে নিরীক্ষার জন্য সেগুলোর একটা লেজার কাগজে প্রিন্ট করে রাখে। কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারী সকালে দেখা গেল, কোন সুইফট ম্যাসেজ আসেনি। এমনকি প্রিন্টারটাও বন্ধ, সেটা কাজ করছে না। তারা সেটাকে চালু করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনোভাবেই সেটাকে চালু করা গেলনা। জোবায়ের ভাবলেন, এটা বোধ হয় একটা কারিগরি ত্রæটি। বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে তিনি বাসায় চলে গেলেন। পরদিন শনিবার অফিসে ফিরে এসে তিনি প্রিন্টারটি আবার চেক করলেন। অন্যদের সহায়তায় এবার প্রিন্টারটি ম্যানুয়ালি চালু করার ব্যবস্থা করলেন। প্রিন্টারটি থেকে একের পর এক প্রিন্ট বের হতে শুরু করল। এর মধ্যে ছিল মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা এক বিলিয়ন ডলার লেনদেন করার অনুরোধের কপিগুলো।
এক সময় বড় বড় ডাকাতিগুলো হতো ব্যাঙ্কে আক্রমণ করে টাকা লুট করে অথবা টাকা পরিবহন করার সময় ডাকাতি করে। ব্রিটেনে এক সময় “গ্রেট ট্রেইন রবারি’ সংঘটিত হয়েছিল, যেখানে ২৫ লক্ষ পাউন্ড ডাকাতি হয়েছিল, ডলারের হিসেবে সেটা ৪০ লক্ষ ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক বিলিয়ন ডলার ডাকাতি করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যাকে বলা যায়, অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় আর অভূতপূর্ব।
বিশ্ব ও মানবজাতির সামনে বর্তমানে চারটি হুমকি রয়েছে। একটা হল মহামারী, যেটা কিছুদিন আগেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। রয়েছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র, জলবায়ু পরিবর্তন। আর চতুর্থটি হল সাইবার ঝুঁকি। নেটওয়ার্ক টেকনোলজির উপর আমাদের অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে সিস্টেম ফেইল বা সাইবার আক্রমণের ফলে এই সমস্যার উদ্ভব হতে পারে।
নব্বইয়ের দশকে যখন হ্যাকারদের ধরা হতো, দেখা যেত তাদের প্রায় সবাই টিনএজার। তাদের সবারই উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়াকে দেখানো, ‘দেখ, আমি কি করতে পারি’। সেসময় ভাইরাস বা ম্যালওয়ার ফ্লপি ডিস্কে ভরে কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু ইন্টারনেট আসার পরই পালটে গেল পরিস্থিতি। মুহূর্তেই ভাইরাস বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে যেতে লাগল। এক ‘আই লাভ ইউ’ ভাইরাস নয় ঘন্টায় সারা দুনিয়ার ৩ লাখ কম্পিউটার সিস্টেমকে আক্রমণ করেছিল।
প্রথম প্রথম মজা করার জন্য শুরু করলেও কিছু কিছু হ্যাকার বুঝতে পারল, হ্যাকিং করে টাকাও কামানো সম্ভব। ২০০০ সালের আগে হ্যাকিং বলতে বুঝাতো ওয়েবসাইট বা ওয়েবপেজ নষ্ট করা। ২০০০ পরবর্তীতে যখন ডটকম ঝড় এল আর সব কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু হলো, টাকা কামানোর জন্য হ্যাকিং শুরু হলো। রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ব্লক ভেঙে যাওয়ার পর যখন সিকিউরিটি সংস্লিষ্ট লোকজন অর্থনীতির নিয়ন্ত্রন নিতে থাকে, কিছুলোক তাদের প্রযুক্তি জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে “গ্যাংস্টার পুঁজিবাদ” অনলাইনে সম্প্রসারণ করে। ভাইরাস লেখা হ্যাকাররা উইন্ডোজ কম্পিউটারকে হ্যাক করার জন্য ভাইরাস লিখতে শুরু করে, সেই কম্পিউটারগুলো ইমেইল স্প্যামারদের কাছে বিক্রি করে, যারা সেগুলোকে ব্যবহার করে স্পাম ছড়াতে শুরু করে ও টাকা আয় করতে শুরু করে। লোকজন সেসময় অনলাইন ব্যাংকিং শুরু করেছিল। হ্যাকাররা লোকজনের ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করে টাকা ট্রান্সফার করতে শুরু করে। শুরুতে লোকজনের কাছ থেকে একেকবারে কয়েক শত থেকে হাজার ডলার চুরি করার মাধ্যমে এই চুরি শুরু করে। একসময় তারা বুঝতে পারে, ব্যক্তির পিছনে সময় নষ্ট না করে ব্যাংকের পিছনে সময় দিলে ভাল হবে। একবার একটা ব্যাংকের ডাটাবেইজে ঢুকতে পারলে কেল্লা ফতে, সেখানে হাজার হাজার ক্রেডিট কার্ডের তথ্য থাকে, সেই তথ্য চুরি করে ব্ল্যাকমার্কেটে বিক্রি করে আয় করা যায়।
সর্বপ্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনে ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করা হয়, উদ্দেশ্য বিভিন্ন কম্পিউটারের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করা। ব্যাংকিং করা বা গুরুত্ব পুর্নস্থাপনা ব্যবস্থাপনা করার জন্য এর সৃষ্টি হয়নি। তথ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার জন্যই এর সৃষ্টি, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এটাকে ডিজাইন করা হয়নি। নব্বইয়ের দশকে যেখানে মাত্র ৩০ হাজার লোক আর কয়েকশ সিস্টেম ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত ছিল, বর্তমানে সেখানে সমগ্র আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থাই ইন্টারনেটে সংযুক্ত। সারা দুনিয়ার ১৫ থেকে ২০ ভাগ জিডিপি ইন্টারনেট নির্ভর। এ থেকে বোঝা যায়, এই ইন্টারনেট ব্যবস্থা বর্তমানে কতটা গুরুত্বপূর্ন। ইন্টারনেট শুধু সম্ভাবনাই তৈরী করেনি, ইন্টারনেটই একটা সম্ভাবনা, যেখানে নিয়মের বালাই নেই, জাতীয় সীমানার সীমাবদ্ধতা নেই, যতদূর কল্পনা করা যায়, ততদূর তার সম্ভাবনার সীমা। একারণেই আমাদের সকল কর্মকান্ড ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে গেছে, আর এই ব্যবস্থাও পাকাপোক্তভাবে গেঁড়ে বসেছে।
হ্যাকাররা যখন প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ট্রান্সফার করার জন্য ৩৫টি লেনদেন অনুরোধ করল, এমন ঘটনা প্রযুক্তি দুনিয়ায় এর আগে ঘটেনি। এর আগে সাইবার অপরাধীরা কয়েকশ, হাজার অথবা কয়েক লাখ ডলার টান্সফার করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ১ বিলিয়ন ডলার ট্রান্সফারের চেষ্টা- এতবড় হ্যাকিং এর ঘটনা এর আগে কখনো শোনা যায়নি। প্রযুক্তি দুনিয়ায় যখন এটা চাউর হয়- কেউ সুইফট ব্যাংকিং সিস্টেম হ্যাক করেছে, বিষয়টি কত বড়, প্রথমে কারো কোন ধারণাই ছিল না। কিন্তু এই হ্যাকিং এর ব্যপকতা দেখে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের হুশ উড়ে যায়।