বাণিজ্য ডেস্ক: বর্তমানে আড়াই লাখ বিদেশি বৈধ-অবৈধভাবে কাজ করছেন বাংলাদেশে। তাদের মধ্যে বৈধভাবে কাজে নিযুক্ত বিদেশিরা ২০২২ সালে ব্যাংকিং চ্যানেলে নিজ দেশে পাঠিয়েছেন ১৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। যদিও বিশ্লেষকরা মনে করেন, ডলারের পরিমাণ আরও বেশি হবে। কারণ অন্যান্য দেশের অনেক লোক বৈধ ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই দেশে কাজ করছেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থার গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নতুন তথ্য অনুসারে, এক বছর আগের তুলনায় রেমিট্যান্সের বহিঃপ্রবাহ ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিরা ১০ কোটি ডলার নিজ দেশে পাঠিয়েছিলেন। ২০২২ সালে এসে বিদেশিদের নিজ দেশে পাঠানো ডলারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ৭০ লাখে। বিশ্বব্যাংক শুধু বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠানো রেমিট্যান্সের হিসাব করেছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশিদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০ সালে বিদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলে নিজ দেশে পাঠিয়েছেন ৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০১৯ সালে ছিল ৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর ২০১৮ সালে ছিল ৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া রেমিট্যান্সের পরিমাণ বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লিখিত চিত্রের চেয়ে অনেক বেশি হবে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং)-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে বহির্মুখী রেমিট্যান্স সরকারিভাবে যতটা হিসাব করা হয় তার চেয়ে ২০ গুণ বেশি হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অনেক ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং শ্রীলঙ্কানের পাশাপাশি কিছু চীনা নাগরিক কোনো যথাযথ ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই বাংলাদেশে কাজ করেন। তারা দেশে অর্থ পাঠাতে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করতে না পারায় অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠান। বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের সঠিক সংখ্যা বলা কঠিন। অনেক সংস্থা বিদেশি নাগরিকদের কাজের অনুমতি দেয় এবং পরিসংখ্যান সমন্বিতভাবে প্রকাশ করা হয় না। যেসব সংস্থা বিদেশি শ্রমিকদের কাজের অনুমতি দেয় তাদের একটি হলো বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। সরকারের এ সংস্থাটি ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিটের ১৫ হাজার ১২৮টি আবেদন অনুমোদন করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮৭.৩২ শতাংশ বেশি। আবেদনকারীরা এসেছেন ১০৬টি দেশ থেকে। এসব বিদেশি নাগরিক বিডা-নিবন্ধিত শিল্প প্রকল্প, বাণিজ্যিক অফিস এবং অন্যান্য সংস্থায় নিযুক্ত আছেন।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা প্রতি বছর অবৈধভাবে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। টিআইবি বলছে, বিভিন্ন সূত্র থেকে তাদের সংগ্রহ করা তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বৈধ এবং অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা কমপক্ষে আড়াই লাখ। তাদের অনেকে কর ফাঁকি দিচ্ছেন, আবার অনেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করে কোনো কর না দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন, যাদের বাধ্যতামূলক উপযুক্ত ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট নেই।
এদিকে সরকারের একটি সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছর পর্যন্ত দেশে ২১২টি দেশের ২ লাখ ১২ হাজার ৬৭ জন নাগরিক অবস্থান করছেন, যা ২০২১ সালের তুলনায় চার গুণ বেশি। দেশে অবস্থানকারী বিদেশি অবৈধ নাগরিকের সংখ্যা ৯৭ হাজার ৬৯৫। এর মধ্যে ভারতের ৬৮ হাজার ৩০৫, চীনের ১৬ হাজার ২৩১, ফিলিপাইনের ৯ হাজার ৯১৫, নাইজেরিয়ার ২ হাজার ৬৮, সোমালিয়ার ১ হাজার ১৫, কেনিয়ার ৭৯ ও ক্যামেরুনের ৮২ জন। এতে প্রতি বছর সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে ৪ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০১৭ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে চীনে ৯৯ কোটি ২০ লাখ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ২৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার, মালয়েশিয়ায় ২০ কোটি ২০ লাখ ডলার এবং ভারতে ১২ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাঠানো হয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছিল। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দেশের মধ্যে ছিল ভিয়েতনাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, থাইল্যান্ড, জাপান, নরওয়ে, মিয়ানমার, যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিল।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের মাধ্যমে। তারা বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন ঠিকই কিন্তু সরকারের হিসাবের বাইরে। অবৈধভাবে কাজ করায় অর্থ পাচারের পাশাপাশি সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দক্ষ পেশাদার কর্মীর চাহিদা থাকায় এর প্রসার ঘটেছে। এসব বিদেশি শ্রমিককে বৈধভাবে কাজের অনুমতি দিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে আরও সহজভাবে সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।