শেখ সাইফুর রহমান
স্থানান্তরযোগ্য বাড়ির কারণে মুন্সিগঞ্জ-দোহার-বিক্রমপুর সবার নজর কেড়েছে। সেখানে এ রকম বাড়ি তৈরি হয়। এমনকি হাটে এ ধরনের একতলা বা দোতলা বাড়ির কেনাবেচাও চলে।
সে রকমই একটি প্রমাণ সাইজের বাড়ি এখন শোভা পাচ্ছে জার্মানির মিউনিখে, পিনাকোথেক ডার মডার্ন মিউজিয়ামের প্রবেশমুখে। দূর থেকে তাকালে চোখে পড়ে কাচের দেয়ালে জ্বলজ্বল করছে একটি প্রদর্শনীর বিশাল পোস্টার-মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস: ইন বাংলাদেশ।
গত ২৮ বছরে মেরিনা তাবাসসুম যেসব সৃষ্টিশীল স্থাপত্যের উদ্ভাবনা করেছেন, তার বাছাই করা নকশা নিয়ে সেখানে চলছে এই প্রদর্শনী; তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী। প্রদর্শনী সাজানো হয়েছে ছবি, অডিও-ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা আর বিরাটকায় বা ক্ষুদ্রাকার বিচিত্র স্থাপনা দিয়ে। কিউরেট করেছেন জার্মানির স্থাপত্য-ইতিহাসবিদ ভেরা সিমোন বাডের। প্রদর্শনীটি এ পর্যন্ত দেখেছেন ২৫ হাজারের বেশি দর্শক। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশকে জেনেছেন।
এ প্রদর্শনীর আয়োজন করতে সময় লেগেছে প্রায় এক বছর। গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে আগামী ১১ই জুন পর্যন্ত চলবে। তিন কক্ষজুড়ে আয়োজিত প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ২০০৬ সালে আগা খান পুরস্কার পাওয়া ঢাকার দক্ষিণ খানের বায়তুরক; রউফ মসজিদ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নির্মিত বাড়িসহ শহরতলি আর শহরের শতাধিক নকশা। এ উপলক্ষ্যে মেরিনা তাবাসসুমের ২৮ বছরের সৃষ্টিশীল সফর নিয়ে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।
১১ জুন মিউনিখ থেকে প্রদর্শনীটি যাবে হল্যান্ডে। প্রদর্শনী চলবে রটারডামে। সেখান থেকে যাবে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে। এরপর প্রদর্শনীটি লন্ডন, নিউইয়র্কসহ আরও কয়েকটি শহরে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে মেরিনা তাবাসসুমের।
মিউজিয়ামে ঢুকে সবাই বিস্মিত হয়ে যাচ্ছেন চরের লোকেদের জন্য তৈরি প্রমাণ সাইজের স্থানান্তরযোগ্য বাড়ির নকশা দেখে। এ নকশার বাস্তবায়ন হচ্ছে বাঁশ আর ইস্পাতের সংযোগে। সেখানে আরও আছে রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি জনপরিসর বা কমিউনিটি স্পেসের নমুনা।
স্থানান্তরযোগ্য বাড়ি তৈরির একটা ইতিহাস আছে, বলছিলেন মেরিনা তাবাসসুম। বেশ কয়েক বছর আগে চর আর চরের মানুষদের নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে শারজা বিয়েনালে সে গবেষণার ভিত্তিতে দোহারে তৈরি এ রকম তিনটি বাড়ির নকশা প্রথম স্থান পায়।
চরের মানুষের ঠাঁইনাড়া জীবনে স্বস্তি দিতে নতুনভাবে ‘খুদি বাড়ি’র (ছোট বাড়ি) নকশা করেন তিনি। করোনার বিধিনিষেধে প্রথম এর নমুনা তৈরি করেন ঢাকায়। যমুনার চর হিজলায় পরপর আরও চারটি। সেগুলোও বর্তমান প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে।
কথায় কথায় জানা গেল এই আয়োজনের নেপথ্য কাহিনি। ২০২০ সালে এই মিউজিয়ামে বক্তৃতা দেওয়ার সময় একটি প্রদর্শনী করার প্রস্তাব দেন মিউজিয়ামের পরিচালক। করোনা অতিমারিতে তাতে বাধা পড়ে। তবে করোনা চলাকালেই টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ তাঁকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। অবশেষে বর্তমান প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া হয়েছে ডক্টরেট উপাধির অভিজ্ঞানপত্র।
‘প্রদর্শ বস্তুর উপস্থাপনার ওপর নির্ভর করে প্রদর্শনী দর্শকদের কাছে কতটা অর্থবহভাবে পৌঁছাবে, কিউরেটর হিসেবে সিমোন এ নিয়ে বারবার আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। বাংলাদেশে এসে আমার প্রকল্পগুলো দেখে প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করেছেন,’ বললেন স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম।
স্থপতি হিসেবে ১৯৯৫ সালে আরবানার সঙ্গে যাত্রা শুরু করেন মেরিনা। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের প্রতিষ্ঠান মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস।