প্রান্তজনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দায় এবং পতিসর

প্রান্তজনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দায় এবং পতিসর

ড. আতিউর রহমান
সব অর্থেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রান্তজনের সখা। পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন তিনি জমিদার হিসাবে। এ সুযোগে মাটি ও মানুষের কাছে এসে সমাজের নানা অসংগতি ও বৈষম্য দেখতে পান। রূপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেও তিনি পূর্ববঙ্গে এসে তন্ন তন্ন করে সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের তল খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব ও দুর্দশা হৃদয় দিয়ে অনুভব করার সুযোগ পান এ সময়টায়। প্রজাদের অভাব ও দুঃখ দূর করার জন্য নানা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেন। শিলাইদহ, শাজাদপুর এবং পতিসরে কৃষি উন্নয়ন, কুটির শিল্পের প্রসার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, গ্রামীণ পূর্তকর্ম, স্বাস্থ্যসেবা, সালিশ-বিচারসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজে নিজের উদ্ভাবনীমূলক চিন্তা ও অর্থের সম্মিলন ঘটান। নিজের সন্তান, বন্ধু ও আত্মীয়দেরও এসব উন্নয়নমূলক কর্মের সঙ্গে যুক্ত করেন। এসব কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতার আলোকে পরে শান্তিনিকেতনে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিটি কর্মদ্যোগের মূলে ছিল মানুষের কল্যাণ। তাই ঘটিয়েছেন তাদের সম্মিলন। তিনি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতেন যে একলা মানুষ টুকরা মাত্র। তাই তাদের একত্রিত হওয়ার আহ্বান তিনি করে গেছেন আজীবন। মণ্ডলী, হিতৈষীসভা কিংবা সমবায় সমিতিসহ তার প্রতিটি উদ্যোগেই ছিল মানুষের সংগঠিত প্রয়াসের প্রতিফলন। সাধারণের হিতাকাঙ্ক্ষী এসব উদ্যোগ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, তিনি ছিলেন তাদেরই একজন। তবে তিনি মানুষের অধিকারে বরাবরই বিশ্বাস করতেন। তিনি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতেন যে, ‘মানুষ কোনো দিন কোনো যথার্থ হিতকে ভিক্ষারূপে গ্রহণ করিবে না, ঋণরূপেও না, কেবলমাত্র প্রাপ্য বলিয়াই গ্রহণ করিতে পারিবে।’ এই প্রাপ্য শব্দটির ব্যবহারেই তিনি মানুষের অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। প্রীতির বন্ধনে মানুষকে আলোড়িত করার পক্ষে ছিলেন। যারা প্রকাশ্যে হিত করার আত্মাভিমানে মত্ত তাদের জন্য এ বার্তাটি তিনি দিয়েছেন যে, ‘হিত করিবার একটি মাত্র ঈশ্বরদত্ত অধিকার আছে, সেটি প্রীতি। প্রীতির দানে কোনো অপমান নাই কিন্তু হিতৈষীতার দানে মানুষের অপমান হয়। মানুষকে সকলের চেয়ে নত করিবার উপায় তাহার হিত করা অথচ তাহাকে প্রীতি না করা।’ তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষ অপর মানুষকে সম্মান করতে পারে না, সে মানুষকে উপকার করতে অক্ষম। মানুষের মনে এ উচ্চতর মূল্যবোধ সৃষ্টির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপায় হচ্ছে শিক্ষা। সুশিক্ষা। সবার জন্য শিক্ষা। কেননা শিক্ষাই সভ্যতার মহাসড়কে ওঠার নির্ভরযোগ্য রাস্তা বা মহাসড়ক। তিনি মনে করতেন সমাজে এমন মানুষও আছে যারা আসলকে ছাড়িয়ে বেশি সুদ গ্রহণ করেন। আবার সমাজের মাথাও হতে চান। তাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলতেন, সেই মহাজন যদি ঋণ গ্রহীতার কাছে সুদের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতাও আদায় করতে চায় তাহলেই মুশকিল। তাকে তিনি ‘শাইলকের বাড়া’ বলে মনে করতেন। এরা কখনো হৃদয় দিয়ে পেছনে পড়ে থাকা মানুষগুলোকে কাছে টানেনি। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি এদের কোনো দায় নেই। ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় উপেনের মনের কষ্ট বোঝাতে তিনি লিখেছেন:
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, “বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, “তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই।
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।’

বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, “শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!’
বাবু কহে হেসে, “বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।’
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে-
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!
যিনি এমন করে বঞ্চিতজনের দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন তিনি নিশ্চয় প্রান্তজনের প্রতি তার দায় কতটা তা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারেন। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’র ‘দুর্ভাগা দেশ’ কবিতায় লিখতে পারেন:
হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছ অপমান/অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।/মানুষের অধিকারে/বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে/আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
এই দুঃখী মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ রবীন্দ্রনাথ তার জমিদারি এস্টেট পতিসরে (যেখানে সিংহভাগ প্রজাই ছিলেন মুসলমান) অসংখ্য উদ্যোগ নেন। আর রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য গ্রাম বলেই পতিসর এখনো ব্যঞ্জনাময়। আজো পতিসরের ধূলিধূসর পথে রবীন্দ্রনাথের গন্ধ পাওয়া যায়। তার মানবিক উন্নয়নের সামাজিক প্রচেষ্টার রেশ আজও বাংলাদেশের গ্রামোন্নয়নের উদ্যোগগুলোর মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রামগুলো ছিল নিরন্ন কৃষকের প্রাণভূমি। কৃষিকাজ আর মাছ ধরাই ছিল তখন গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা। কৃষিপ্রযুক্তিও ছিল সেকেলে। প্রকৃতিই ছিল তাদের খেয়ে পরে বাঁচার প্রধান উৎস। গবেষকরা বলেন, পতিসরের প্রাণ-প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গির ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। আর এ কারণে জমিদারির আবরণ ছেড়ে তিনি সাধারণ মানুষের উন্নয়নে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন। এখানকার প্রজাদের সঙ্গে গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নওগাঁ, বগুড়া ও নাটোর জেলায় অন্তত ৬ শতাংশ গ্রাম নিয়ে কালিগ্রাম পরগনার আয়তন ছিল। পূর্ববাংলায় থাকার সময়ই তিনি গ্রামবাংলার জীবনাচার, লোকাচার, অর্থনীতি সম্পর্কেও ভালো জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। আর এ কারণেই তাই পরে প্রজা সাধারণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। ছেলে রথিকেও এ কর্মযজ্ঞে যুক্ত করেছিলেন। মেয়ের জামাই নগেনকেও এসব কাজে উৎসাহী করেছিলেন। ১৯০৫ সালে মিডল ইংলিশ (এম. ই) স্কুল স্থাপন করে এ অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারের কাজ শুরু করেছিলেন। মাটির দেওয়ালের ওপর টিন ও টালির ছাউনিতে স্কুলটির যাত্রা। ‘শুধু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, উপদেশ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ক্ষান্ত হননি বরং শিলাইদহ ও কালীগ্রামে হাতেকলমে এ কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন’। পতিসরে রবীন্দ্রনাথের সামাজিক কর্ম প্রক্রিয়াকে আমরা দুভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমত পতিসরের উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ এবং দ্বিতীয়ত পতিসরের তার সামগ্রিক সাহিত্যচর্চা। পতিসর হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব জমিদারি। তার নবসৃষ্টির উৎসভূমি।
১৮৯১ সালের ১৩ জানুয়ারি নিজ জমিদারি পতিসরে আসেন রবীন্দ্রনাথ। এসে কবি চারদিকে ঘুরে ফিরে বেড়ান। নাগর নদীতে ভেসে বেড়ান নৌকায়। নাগর নদীর পাড়ে, মাঠে এবং আশপাশেও হেঁটে বেড়ান। সে দেখার অভিজ্ঞতা নিঃশব্দে প্রভাব ফেলে কবির অন্তরে। তাই তাকে বলতে শুনি ‘তোমরা যে পার যেখানে পার এক-একটি গ্রামের ভার গ্রহণ করিয়া সেখানে গিয়া আশ্রয় লও। গ্রামগুলিকে ব্যবস্থাবদ্ধ করো। শিক্ষা দাও, কৃষি শিল্প ও গ্রামের ব্যবহারসামগ্রী সম্বন্ধে নতুন চেষ্টা প্রবর্তিত করো’ (রবীন্দ্ররচনাবলী ১০ম খণ্ড পৃ. ৫২০-২১)। এ প্রভাব তার মানবিক চেতনাকে উদ্দীপ্ত করেছে বলেই সম্ভবত তাকে সাধারণ মানুষের, দুস্থ চাষির জটিল সমস্যা-সংকুল জীবনের গভীরে নিয়ে গেছে খুবই স্বাভাবিকভাবে। আর তাদের জন্য কিছু করার উদ্যোগ নেওয়ার উৎসাহ তিনি এ অনুসন্ধিৎসু মনের আকুতি থেকেই পেয়েছিলেন। এ এলাকার প্রজা চাষিদের দুঃখ দুর্দশার প্রধান কারণ ছিল অশিক্ষা। অন্যদিকে নিজ জমিদারি কালীগ্রামের সহজ সরল অল্প আয়ের সল্প শিক্ষিত মানুষগুলোর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অনুভবের মধ্য দিয়ে কবি লিখেছেন ‘কোথায় প্যারিসের আর্টিস্ট-সম্প্রদায়ের উদ্দাম উন্মত্ততা আর কোথায় আমার কালীগ্রামের সরল চাষি প্রজাদের দুঃখ দৈন্য-নিবেদন! এদের অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং এদের অসহ্য কষ্ট দেখলে আমার চোখে জল আসে। বাস্তবিক এরা যেন আমার একটি দেশ জোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক’। সেই উপলব্ধি থেকে প্রায় ২০০টি গ্রামে অবৈতনিক পাঠশালা এবং ৩টি উচ্চবিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এ অঞ্চলের শিক্ষার ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন। পাশাপাশি প্রজাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য দাতব্য চিকিৎসালয়, আধুনিক কৃষিব্যবস্থা, কৃষি সমবায় ব্যাংক (১৯০৫) স্থাপনের মাধ্যমে তিনি পতিসরে সমাজ সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন। আজ থেকে শত বছরেরও আগে পল্লিগঠন, গ্রাম উন্নয়ন ও ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচির গোড়াপত্তন করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
চলবে

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *