পল্লী চিকিৎসক যখন পরিবেশের ডাক্তার

পল্লী চিকিৎসক যখন পরিবেশের ডাক্তার

রায়হান রাশেদ: ভোরের আলো ফোটার আগেই মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন খোরশেদ। মোটর সাইকেলের সামনে ব্যাগে থাকে শুকনা খাবার, দোকানের চাবি, ওষুধ ইত্যাদি। আর পেছনে বাঁধা থাকে কোদাল, খুন্তি, শাবল ও কাস্তে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত তালগাছের পরিচর্যা করেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শতাধিক তালগাছের যতœ নেওয়া হয়ে যায়। এভাবে ১০ বছর ধরে নিয়ম করে পরিচর্যা করছেন। শুরুতে লোকে নানা কথা বলত। এখন সবাই খোরশেদকে বলে ‘তালগাছ পাগল ডাক্তার’।

বাড়ি তাঁর ঠাকুরগাঁও সদরের চিলারং ইউনিয়নের পাহাড়ভাঙ্গায়। ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি পড়তে পারেননি। এখন বোর্ডবাজার অফিসে ছোট একটি দোকানে ওষুধ বিক্রি করেন। ছোটদের বই বেচেন। সেখানে পাঁচ দিন বসেন। সপ্তাহের দুই দিন যান আখানগর বাজার। সেখানেও ওষুধ আর বই বেচেন। আর শুক্রবার গ্রামের মসজিদে জুমার নামাজ পড়ান।

‘ডাক্তার’ বনে গেলেন
১৯৯২ সাল। পাহাড়ভাঙ্গায় ও আশপাশে কোনো ডাক্তার ছিল না। ওষুধ লাগলে যেতে হতো ঠাকুরগাঁও সদরে। খোরশেদ আলীর প্রায়ই মাথা ব্যথা ও জ্বর হতো। এত দূর গিয়ে দাওয়াই আনতে মন চাইত না। একদিন ঠাকুরগাঁও থেকে অনেক ওষুধ নিয়ে এলেন। কারো জ্বরের কথা শুনলে ওষুধ দিয়ে আসতেন। এভাবে তাঁর পরিচিতি বাড়ে। কারো জ্বর, মাথা ব্যথা, পেট খারাপ কিংবা অন্য সমস্যা হলেই তাঁর ডাক পড়ে। তিনি ওষুধ দিয়ে আসেন। এভাবে ‘ডাক্তার’ বনে গেলেন। বললেন, ‘সময় আমাকে ডাক্তার বানিয়েছে। বাজারে আমার ছোট একটা দোকান আছে। মানুষ বাকিতে ওষুধ নেয়। এভাবে ৪০ বছর ধরে চলছে।’ পাহাড়ভাঙ্গার মিলন মিয়া বললেন, ‘খোরশেদ চাচা বড় ভালো মানুষ।’

শুরুর গল্প
১৯৯২ সালে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় আসেন খোরশেদ। ঠিক করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখতে যাবেন। এক দুপুরে ধানমন্ডি ৩২-এ গেলেন। ‘বড় মায়া লাগল বাড়িটা দেখে। রক্তের দাগ, কাপড়ের জায়গায় কাপড় পড়ে আছে, জুতার জায়গায় জুতা। মন্তব্যের খাতায় লিখলাম, আল্লাহ এঁদের তুমি জান্নাতবাসী করো। ঠিক করলাম, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নামে তালগাছ লাগাব। মানুষ তাল খাবে। অক্সিজেন পাবে। বজ্রপাত থেকেও রক্ষা পাবে। পাখিরা বাসা বাঁধবে।’ বললেন খোরশেদ। তবে ঢাকা থেকে ফেরার পর পাহাড়ভাঙ্গার বড় রাস্তার পাশে তালগাছ নয়, প্রথমে লাগিয়েছেন কাঁঠালের চারা। একসময় গিয়ে দেখেন, গাছের পাতা পর্যন্ত নেই। ছাগল খেয়ে ফেলেছে। তারপর লাগালেন ইউক্যালিপটাস। সেটাও টিকল না। ২০১৩ সালে চিলারংয়ের রাস্তার দুই পাশে তালের বীজ বপন শুরু করেন। সেবার পাঁচ হাজার বীজ বপন করেছিলেন।

রাতে বীজ বপন করেন
শুরুতে দিনের বেলা বপন করতেন। মানুষ এসে নানা কথা বলত। বকা দিত। জমিওয়ালারা জমির সামনে লাগাতে নিষেধ করত। তবু তিনি থামেননি। কিন্তু পরদিন গিয়ে দেখতেন, মাটি খুঁড়ে কারা যেন বীজ নিয়ে গেছে। বড় হওয়ার পর কেউ আবার গাছসুদ্ধ কেটে দেয়। খোরশেদ কষ্ট পান। তবে থেমে যান না। সেই জায়গায় আবার বীজ লাগান। ২০১৫ সাল থেকে রাতেই বীজ বপন শুরু করলেন। বললেন, ‘আমি আর পারছিলাম না। পরে রাত বেছে নিলাম। অনেকে এসে বলে, সরকারি জায়গায় লাগায়েন না। মাথায় তাল পড়ে মানুষ মারা যাবে। কতজন কত কথা বলে। আমি তবু তালগাছ লাগাতেই ভালোবাসি।’ কয়েক বছর আগে এক রাতে বীজ লাগাচ্ছিলেন। কয়েকটি গাড়ি এসে থামল তাঁর কাছে। তিনি আপনমনে কাজ করছেন। দেখলেন, সেনাবাহিনীর বহর। তারা বীজ বপনের কথা জানতে পেরে ধন্যবাদ দেয়।

যত্ন নেন যেভাবে
ভাদ্র মাসে তালের বীজ বপন করতে হয়। তখন মাটি নরম থাকে। এ জন্য ৬ ইঞ্চি গর্ত খুঁড়তে হয়। এক বছরের মধ্যে পাতা গজায়। বছর বছর পাতার সংখ্যা বাড়ে। তখন আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। মাটি নিড়িয়ে দিতে হয়। পানি লাগে। তবে অন্য গাছের চারার মতো খুঁটি দিতে হয় না। কারণ তালের চারা বাতাসে ভেঙে পড়ে না।
যেভাবে সংগ্রহ করেন

বাড়ি থেকে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে বড় খটাবাড়ী হাট। সেখানে তালের হাট বসে। বাসুদেব ও নজরুল পাইকারের কাছ থেকে তালের বীজ আনেন। বললেন, ‘প্রথম দিন আমি তাদের সব বীজ কিনে নিলাম। তারা কিছুটা অবাক হলো। এরপর যখন শত শত অর্ডার করতে থাকলাম, তারা তাজ্জব বনে গেল। বলল, এত বীজ দিয়ে কী করবেন? রাস্তার ধারে বপন করি জেনে খুশি হলো তারা। একেকটি বীজের দাম পড়ে পাঁচ টাকার মতো।’ বললেন খোরশেদ।

যেখানে যেখানে লাগিয়েছেন
ঠাকুরগাঁও সদরের বালিয়াডাঙ্গী থেকে শুরু করে পল্লী বিদ্যুৎ, পল্লী বিদ্যুৎ থেকে আখানগর রেলস্টেশন, সেখান থেকে ভুপসের হাট, ভুপসের হাট থেকে বাজরা, সেখান থেকে রেলহুন্ডি, কিছুদূর এগিয়ে আবার বোর্ড অফিস, পাহাড়ভাঙ্গার রাস্তায়, চিলারং ইউনিয়নের প্রায় সব রাস্তায় বীজ বপন করেছেন। প্রায় ২০ মাইলের বেশি রাস্তায় বীজ বপন করেছেন তিনি।

৩০ হাজারের মতো টিকে গেছে
প্রথম বছর পাঁচ হাজার বীজ লাগিয়েছেন। পরের বছর সাত হাজার। এভাবে এখন পর্যন্ত ৫২ হাজার বীজ বপন করেছেন। এর মধ্যে অনেকগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। রাস্তার পাশের জমির মালিকরা কিছু কেটে দিয়েছেন। খোরশেদ সেসব জায়গায় আবার বপন করেছেন। বর্তমানে ৩০ হাজারের মতো টিকে গেছে। কোনোটা হাঁটু কিংবা কোমর সমান হয়েছে। কোনোটার এক পাতা, দুই পাতা গজিয়েছে।

জমি বেচে দিলেন
খোরশেদ পণ করেছেন অন্তত এক লাখ বীজ বপন করবেন। কিন্তু এর মধ্যে বীজ কেনা ও পরিচর্যায় শ্রমিককে টাকা দিতে গিয়ে নিজের সব সঞ্চয় খুইয়েছেন। একসময় দেখলেন, পকেট ফাঁকা। কিন্তু পরিচর্যা না করলে গাছ বাঁচবে না। এ জন্য শ্রমিক দরকার। দরকার টাকা। পরে পাঁচ বিঘা জমি বেচে দিলেন। স্ত্রী ও সন্তানরা খেপে গেল তাঁর ওপর। বীজ বপনে বাধা দিল। খোরশেদ সালিস ডাকলেন। চেয়ারম্যানসহ এলাকার মুরব্বিরা এলেন। খোরশেদ বললেন, ‘গাছ বাঁচাতে প্রয়োজনে সব বেচে দেব। কারণ ওরা আমার সন্তানের মতো।’ পরে দরবারের সিদ্ধান্তে ছয় ছেলে এখন তাঁকে প্রতি মাসে এক হাজার করে টাকা দেয়। সেই ছয় হাজার টাকার সঙ্গে নিজের উপার্জিত টাকা দিয়ে তিনি গাছের পরিচর্যা করেন।

তালগাছ রোপণ নিয়ে প্রায়ই বিরক্ত হন স্ত্রী। বলেন, ‘সন্তান আর সংসারের খবর নাই। আছে তালগাছ নিয়া।’ খোরশেদ বললেন, ‘সন্তানরা যদি আমাকে টাকা না দেয়, উপার্জনও যদি করতে না পারি, ভিক্ষা করে হলেও গাছ লাগাব। এক লাখ তাল গাছ লাগিয়ে তবেই থামব।’

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *