ড. তোফায়েল আহমদ মাদানি: যদিও নাত বলতে ইসলামি সংগীতের বিশেষ একটি ধারাকে বোঝানো হয়, তবে পরিভাষায় মহানবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসায় রচিত যেকোনো গদ্য ও পদ্যকে নাত বলা হয়। ভাষা ও সাহিত্যের সব ধারায় নাত বা নবিজি (সা.)-এর স্তুতি খুঁজে পাওয়া যায়; তবে কবিতা, গীতিকবিতা ও গজল মানুষের হৃদয় বেশি স্পর্শ করেছে।
হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রশংসা করা এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মুমিনের ইমানের দাবি। তবে তাঁর ব্যাপারে কোনো কবিতা বা সংগীত রচনার আগে তাঁকে জানা ও চেনা আবশ্যক। তাঁর সত্তা ও গুণাবলিতে যে অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য রয়েছে, তা অবলোকন করা প্রয়োজন। কেননা তাঁর পবিত্র সত্তা, তাঁর সুবাসিত গুণাবলি ও প্রশংসনীয় কাজগুলো তাঁকে মাকামে মাহমুদে (সুমহান মর্যাদায়) অধিষ্ঠিত করেছে। মাকামে মাহমুদ হলো এমন প্রশংসনীয় স্তর, যাতে উপনীত হলে মানুষ ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে চলে যায়। এই স্তর মানুষকে প্রশংসাকারীর প্রশংসা থেকে অমুখাপেক্ষী করে দেয়, সেই প্রশংসায় যত আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসা থাকুক না কেন। বরং বাস্তবতা হলো, হযরত আমেনা (আ.)-এর কলিজার টুকরা এবং হযরত আবদুল্লাহ (আ.)-এর চোখের জ্যোতি মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর প্রশংসা করা প্রতিটি মানুষের অরশ্য কর্তব্য। কেননা স্বয়ং রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রশংসা করেছেন। পবিত্র কুরআনের শব্দে শব্দে যাঁর মর্যাদা, সৌন্দর্য ও প্রশংসা বর্ণনা করা হয়েছে।
যে দরবারে বড় বড় নবি-রাসুলগণ বিশ্বাস ও ভালোবাসার নজরানা পেশ করেছেন, তাঁর সুমহান দরবারে যদি কোনো কিছু পেশ করার সুযোগ হয় তবে তাকে আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সৌভাগ্য মনে করা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সভাকবি হাসসান বিন সাবিত (রা.) বলেন, ‘আমি তো আমার ভাষা দিয়ে মুহাম্মদের প্রশংসা করিনি, বরং মুহাম্মদের মাধ্যমে আমার ভাষাকে প্রশংসিত করেছি।’ এজন্য বড় বড় কবি, ভাষাবিদ, সাহিত্যিক, জ্ঞানী, গুণী ও পণ্ডিত ব্যক্তি তাঁর প্রশংসা ও স্তুতি গাওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। আল্লামা জামি (রহ.) বলেন, ‘তাঁর যথাযথ প্রশংসা করা সম্ভব নয়।’
এই অক্ষমতার পরও যদি পূর্ণ ভক্তি, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে মহানবি (সা.)-এর নাম উচ্চারণ করা সম্ভব হয়, সেটাও কম সৌভাগ্যের নয়। কেননা তাঁর ভালোবাসা হৃদয়ে ধারণ করতে পারাও কম কিছু নয়। হাফেজ সিরাজি (রহ.) বলেন, ‘হাজারবার মিশক ও গোলাপের সুঘ্রাণে মিশিয়ে আপনার নাম উচ্চারণ করাও শিষ্টাচারবহির্ভূত মনে হয়।’
কোনো সন্দেহ নেই, ইসলামের আগমন ঘটার পরই নাত বা নবীজি (সা.)-এর স্তুতি সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল। আরবি ভাষায় তাঁর প্রশাংসায় কাব্য রচনাকারীদের ভেতর হাসসান বিন সাবিত (রা.)-এর নাম সবার ওপরে। যিনি মহানবী (সা.)-এর মর্যাদায় কবিতা রচনা করতেন এবং নিজেই তাঁকে তা পাঠ করে শোনাতেন। তিনি হাসসান (রা.)-এর কবিতা শুনে খুশি হতেন। আল্লাহ্ ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমি আপনার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি।’ (সুরা ইনশিরাহ, আয়াত ৪) মহান আল্লাহ্ নিজেই যাঁর খ্যাতি ও মর্যাদা উঁচু করেছেন।
কবি তার হৃদয়ে যতক্ষণ না মহানবী (সা.)-এর পূর্ণ ভালোবাসা ধারণ করতে পারবে, ততক্ষণ তার পক্ষে সার্থক নাত রচনা করা সম্ভব নয়। কবি যখন ভালোবাসার রসদ সংগ্রহ করতে পারবে, নবীজি (সা.)-এর আবেগে হৃদয় উদ্বেলিত হবে, তখন এমন নাত রচিত হবে, যার প্রতিটি শব্দে প্রাণের উচ্ছ্বাস খেলা করবে। যেমনটি দেখা যেত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শানে রচিত হাসসান বিন সাবিত, আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা, কা’ব বিন মালিক (রা.)-এর কাব্যকথায়। ইমাম বুছিরি (রহ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রশংসায় ‘কাসিদায়ে বুরদা’ নামে বিখ্যাত কবিতা রচনা করেন। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘রাসুল হলেন ঝলমলে আলো, যেন তিনি আল্লাহর মুক্ত তরবারি।’ স্বপ্নে তাঁর এই কবিতা শুনে নবীজি (সা.) তাঁকে নিজের গায়ের চাদর খুলে দেন। নবিপ্রেমের বিরল দৃষ্টান্ত কাসিদায়ে বুরদা।