সুমন সাজ্জাদ: সেই কবে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে সুর ও বাণীর; অথচ এককালে দুটিই ছিল এক দেহে লীন। আমরা যাকে কবিতা বলে জানি তার সঙ্গে জোড় বেঁধেছিল সুর। কবিমাত্রই ছিলেন সুরের সাধক। একালে যাত্রাপথ আলাদা।
কবির দায় নেই সুরের বোঝা কাঁধে নেওয়ার। কথাকে সুরের কাঁধে বসিয়ে দিতে প্রস্তুত আছেন সুরকার। ইতিহাসের এমন বহু পর্ব ছিল বাঙালি যখন গান ও কবিতা, কথা ও সংগীতকে আলাদা করে ভাবতে শেখেনি। কিন্তু মৌখিক সংস্কৃতির সঙ্গে মধ্যবিত্তের দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকল স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অভ্যাস। কবিতার বইয়ের কোনো কোনো লেখার গায়ে কবিরা বিশিষ্টভাবে উল্লেখ করতে আরম্ভ করলেন ‘গীত’ কিংবা ‘একটি গীত’; তার মানে হলো সুর দিয়ে গাওয়া যাবে কিংবা হয়তো কবি নিজেই সম্ভাব্য সুর গড়ে রেখেছেন। উনিশ শতকের বাংলা কবিতার কোনো কোনো বইয়ে দেখা যাবে এই প্রবণতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা লিখলেন, একই সঙ্গে গানও লিখলেন। নজরুল সুর দিলেন নিজের কথায়। আবার তাঁর বাণীতে সুরের টান দিলেন অন্য সুরকাররা।
ঔপনিবেশিক ইতিহাসে এই বদলে যাওয়া প্রজন্ম ও সংস্কৃতির প্রভাববিস্তারী একজন নজরুল। স্বল্পকালীন আলোয় তিনি ভরিয়ে তুলেছিলেন বাংলা গানের ইতিহাস। তবে তাঁর অবারিত ও অসংখ্য গানের দিকে আমরা চোখ ফিরিয়েছি কমই। কোনো কোনো লেখার খ্যাতি কখনো কখনো কবি-লেখকদের জীবনে ট্র্যাজিক ঝড় বইয়ে দেয়, যা তাঁর লেখকজীবনের বাকি সব কিছুকে গ্রাস করে ফেলে। নজরুলের ক্ষেত্রে সম্ভবত বিদ্রোহী কবির খ্যাতি সেরকম একটি ঝড়। কিন্তু তাঁর সেই উপাধিটির ভার কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে নিয়ে যদি তাঁর গানের দিকে চোখ মেলি, তাহলে দেখতে পাব, আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ অন্য এক নজরুল; গানের নজরুল, গানের ভেতর তীব্রভাবে লুকিয়ে থাকা ‘কবিতার নজরুল’, বিচিত্র রাগ ও অনুরাগ, ভাব ও বিভাবের নজরুল। আর হ্যাঁ, তাঁর বিদ্রোহের রূপটিও অপ্রকাশিত থাকেনি। গানে গানে ছড়িয়ে দিয়েছেন ভালোবাসা ও বিদ্রোহের বাণ।
গানের নজরুলকে বলা যায় ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক প্রিয়তম বাক্যাংশ। অবশ্য ঠাকুরের এই শব্দ-সমাবেশ নজরুলকে লক্ষ্য করে নয়। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতাকে বুঝতে গিয়ে ৮০ বছরের দীর্ঘ জীবনে তিনি বহুবার ঐক্যের ধারণাকে হাজির করেছিলেন। নজরুলের গানকে মনে হয় ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ ধারণার এক প্রায়োগিক বিস্তার। আমরা চমকে তাকাই তাঁর গানের বিপুলতা ও বিভিন্নতা দেখে।
একদিকে রাগসংগীত তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারী’, ‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’, ‘আজি মনে মনে লাগে হোরী’, ‘আজি কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া’, ‘কাবেরী নদী-জলে কে গো বালিকা’; অন্যদিকে কবিতার চোরাটানে তিনি লিখেছেন, ‘আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়’, ‘আমার গানের মালা আমি’, ‘গানগুলি মোর আহত পাখীর সম’, ‘মনের রং লেগেছে’। নজরুল একদিকে লিখলেন, ‘এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি/(খোদা) তোমার মেহেরবানি’, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’, ‘খোদার প্রেমের শারাব পিয়ে বেঁহুশ হয়ে রই প’ড়ে’। অন্যদিকে লিখলেন, ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়’, ‘এল নন্দের নন্দন নব-ঘনশ্যাম’।
একই নজরুল গজলের কাঠামো অনুসরণ করে লিখলেন, ‘আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন’, ‘আমার যাবার সময় হ’ল দাও বিদায়’, ‘গুল্-বাগিচার বুলবুলি আমি’, ‘চেয়ো না সুনয়না’, ‘পথ চলিতে যদি চকিতে’। আবার বাংলার লোকায়ত সুর মনে রেখে তৈরি করে ফেললেন ‘এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে’, ‘রাঙা মাটির পথে লো’, ‘কুঁচ-বরন কন্যা রে তোর মেঘ-বরন কেশ’। বৈচিত্র্যের আরেক স্বাক্ষর হয়ে দেখা দিল সাঁওতালি বা ঝুমুরের সুরে গাঁথা গানগুলো। এমনকি হিন্দি ভাষায় লিখলেন, ‘কৃষ্ণ কানাইয়া আয়ো মনমে মোহন মুরলী বাজাও’, ‘নাচে যশোদাকে আঙনামে শিশু গোপাল’।
কেন এই বৈচিত্র্যের মেলা? এই প্রশ্নের বেশ কিছু চটজলদি জবাব আমরা ভেবে নিতে পারি। শুরুতেই বলতে পারি, বৈচিত্র্যের পেছনে ছিল গ্রামোফোন কম্পানিগুলোর পুঁজি ও মুনাফার তাগিদ; যত বেশি শ্রোতার কাছে পৌঁছানো যায়, ততই পয়সা। এই বয়ানও গভীরভাবে সত্য। গ্রামোফোন কম্পানির চাপে নজরুল প্রচুর গান লিখেছেন। মনে হতে পারে, একেবারেই আন্তর প্রেরণাহীন প্রয়াসে গানগুলো সৃষ্টি নয়, ‘উৎপাদন’ করেছেন। আর তাঁর হাতে বেজে উঠেছিল মায়াবী পয়সার ঝনঝনানি।
গানকেন্দ্রিক সংস্কৃতি কারখানায় নজরুল ছিলেন প্রধান সাংস্কৃতিক পুঁজি। সংস্কৃতি কারখানা উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, বিনিয়োগ ও মুনাফায় বিশ্বাসী। কিন্তু লেখকের জন্য দরকার পড়ে হৃদয়গত প্রেরণার, যা তাঁকে উদ্দীপিত আর আলোড়িত করে। তবে সবসময় প্রেরণার দরকার পড়ে না, তেমন প্রমাণ রেখেছেন নজরুল। তাই তাৎক্ষণিক প্ররোচনায় লিখে ফেলেছেন অমর সব গান। এর একটি ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেবো খোঁপায় তারার ফুল’। শিল্পী আব্বাসউদ্দীনকে বসিয়ে রেখে লিখেছিলেন, ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’; তারই সূত্রে তৈরি হয়েছিল ইসলামি গানের জোয়ার।
বৈচিত্র্য বিষয়ে আরো একটি জবাব হতে পারে এই যে নজরুল বাংলা গানের নতুনতর রূপের খোঁজে ছুটেছিলেন-যার আধুনিকায়নে ব্যবহৃত হবে অ-ইউরোপীয় উপাদান; যেমন তিনি ব্যবহার করেছেন কবিতায়। নবীনতার খোঁজে রবীন্দ্রনাথ যেমন ব্যবহার করেছিলেন আইরিশ-স্কটিশ অনুষঙ্গ। মর্মের নিকটতম হিসেবে নজরুল হাত পেতেছিলেন আরব-পারস্যে। তাই বলে নজরুল ‘আধুনিক’ গান লেখেননি, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো গানের গায়ে লেখা আছে ‘আধুনিক’, ‘মডার্ন’। নিজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবেশের সঙ্গে ‘অন্য’, ‘ভিন্ন’ কিংবা ‘অপর’ সংস্কৃতির এই অভিযোজন ও সংযুক্তি বহন করছে নজরুলের প্রসারিত চৈতন্যের ইঙ্গিত, যা একই সঙ্গে হাজির করছে আধুনিকায়নের বিকল্প প্রস্তাবনা।
আমি ভাবি, নজরুলের সংগীত বৈচিত্র্যের মূলে ছিল একটি দেশ, অঞ্চল ও স্থানকেন্দ্রিক প্রকল্পনা। ভৌগোলিক ও স্থানিক পরিচয়ে যেটি ভারতীয় উপমহাদেশ নামে খ্যাত। ভাষিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এই অঞ্চল নিশ্চিতভাবেই বহুমাত্রিক। গানের বাণী ও বিন্যাসে অঞ্চলগত এই পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলেন নজরুল। সেই পরিচয়ে বাঙালি ও বাংলা একটি অংশমাত্র। দেশবিষয়ক গানগুলোতে নজরুল তুলে এনেছেন ‘অখণ্ড ভারতীয়তা’, ব্যবহার করেছেন সেই বহুখ্যাত স্লেগান ‘বন্দেমাতরম্’।
নজরুলের শব্দসম্ভারে এটিই ‘ধ্যানের ভারত’। আর অবশ্যই এই ভারতকে ধারণ করে আছে মাতৃপ্রতীক। নজরুলের শ্যামা মাকে পাওয়া যায় দেশের মূর্তিতে। সে মা শক্তিময়ী। আরেকটি গানে নারীর স্বর যোজনা করে বলেছেন, ‘আমি মহাভারতী শক্তিনারী’। মায়ের আদুরে রূপের কাছে প্রণতি জানিয়ে লিখেছেন, ‘মা আঁধার রাতে একলা জাগে/আগেল রে ঐ শ্মশান-ঘাঁটি’। কিন্তু নজরুলের বাংলা মায়ের স্থান কোথায়? রাজনৈতিকভাবে নজরুলের বাংলা মা আটকে আছে প্রাদেশিক পরিকাঠামোতে। সেই মায়ের জন্যও বয়ে গেছে অবিরল কথার স্রোত, ‘আমার শ্যামলা বরন বাংলা মায়ের/রূপ দেখে যা, আয় রে আয়। ’
বিশ শতকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী মধ্যবিত্তের দুটি রাজনৈতিক মা: একটি তার প্রাদেশিক রূপ-বঙ্গমাতা, অন্যটি তার অখণ্ড ও সর্বজনীন রূপ- ভারতমাতা। বিশের দশকে এই দুই মা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছিলেন কবি-গীতিকারদের বয়ানে। রাজনৈতিক পরিসরে দুই জননীতত্ত্ব বিষয়ক টানাপড়েন থাকলেও নজরুলের গানে সেই দ্বান্দ্বিকতা একেবারেই শূন্য হয়ে গেছে। এর প্রমাণ, তিনি বলছেন, ‘আমার সোনার হিন্দুস্থান!/দেশ-দেশ-নন্দিতা তুমি বিশ্বের প্রাণ। /ধরণীর জ্যেষ্ঠ কন্যা তুমি আদি মাতা,/তব পুত্র গাহিল বেদ-বেদান্ত সাম-গাথা/তব কোলে বারে বারে এল ভগবান্।’ সময়ের সূত্র মেনেই যেন নজরুলের গানে একাকার হয়ে গেছে বাংলা-হিন্দুস্তান, বাংলা-ভারত। নজরুল প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এই দেশ কার? তোর নহে আর। /রে মূঢ় সন্তান! ভারত-মাতার।’ মায়ের প্রতীকে নজরুল জীবনভর এই দেশটিকেই খুঁজেছিলেন।
জাতীয়তাবাদ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, সশস্ত্র সংগ্রাম, অসহযোগ আন্দোলন-ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্ত নজরুলের সামনে হাজির করেছে দেশমাতার ধারণা। এই দেশ কোনো সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীর নয়। বৈচিত্র্য ও ভিন্নতার এক সমবেত বয়ান এই দেশ। গানের বাণী ও সুর দিয়ে নজরুল পৌঁছে যেতে চেয়েছেন দেশ ও জনতার মর্মে। আর জনতা কখনোই একমাত্রিক রূপ নিয়ে বিদ্যমান থাকে না। জনতা সব সময়ই বহুবাচনিক উচ্চারণের দ্যোতক। নজরুল তাই জনতার জন্য লেখেন শ্রমিকের গান, কৃষকের গান, শ্যামার গান, পল্লীর গান, ইসলামের গান, আধুনিক গান, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর গান, শ্রীকৃষ্ণের গান। বিচিত্র রূপ ও রসের গানে বহুমুখী জনতার মুখচ্ছবি ধরা পড়ে।
জনতার স্মৃতি ও শ্রুতিকে আনন্দে ভাসিয়ে দিয়ে নজরুল পৌঁছে গিয়েছেন একাল অবধি-যেখানে ভেঙে গেছে ‘ভারত-মাতা’র ধারণা, বাঙালির জাতীয়তাবাদও ডুবে গেছে দ্বিধা ও সংশয়ের চোরাবালিতে। কিন্তু ছিঁড়ে যায়নি নজরুলের গানের মালার সুতো, গীত শেষে নীরব বীণাও ঢাকা পড়েনি ধুলোর আস্তরণে, সংগীত ও সুরস্পর্শী ব্যক্তিরা জানেন নজরুল গানের ভেতর দিয়ে ভুবনখানিকে দেখতে চেয়েছিলেন, দেখতে চেয়েছিলেন বাঙালি ও বঙ্গদেশকে। নজরুলের গান শুনতে শুনতে আমাদের চোখের সামনে ধরা পড়ছে কি সেই বিচিত্র ভুবনখানি, সেই বিচিত্র বাংলাদেশ?