রেজাউল করিম খোকন: বিশ্বের কৃষিপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। বৈশ্বিক গড় হারের চেয়ে এখন বেশি নারী দেশের কৃষি খাতে জড়িত। তবে মোবাইল ফোন সেবা, ইন্টারনেট প্রযুক্তি থেকে শুরু করে জমির মালিকানায় তারা এখনও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যেও সীমিত সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা কৃষিতে বিরাট অবদান রাখছেন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আন্তর্জাতিক কৃষিব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা নিয়ে ‘স্ট্যাটাস অব উইমেন ইন অ্যাগ্রিকালচার সিস্টেম-২০২৩’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কৃষিতে ২০০৫ সালে নারীর ভূমিকা ছিল ৩৬.২ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা ৯.১ শতাংশ বেড়ে ৪৫.৩ শতাংশে দাঁড়ায়। কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বিশ্বে এটিই সর্বোচ্চ। এরপর রয়েছে নেপাল। একই সময়ে সে দেশে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ৮.৪ শতাংশ। আর তৃতীয় স্থানে থাকা মধ্য আমেরিকার দেশ এল সালভাদরে বেড়েছে ৮.১ শতাংশ। বৈশ্বিকভাবে কৃষিতে নারীর ভূমিকা প্রায় ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার বৈশ্বিক গড় হারের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশের নারীরা যে কৃষিতে বিপুল অবদান রাখছেন, গবাদিপশু খাতে নজর দিলেই এর প্রমাণ মেলে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, এবার কোরবানিতে গবাদিপশুর বড় অংশ এসেছে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের কাছ থেকে। দেশে এমন প্রায় ১০ লাখ খামার রয়েছে, যার প্রায় ৬০ শতাংশ চালান গ্রামীণ নারীরা। বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত ব্যাক বেঙ্গল ছাগলের ৯০ শতাংশ লালন-পালন করেন নারীরা। বাংলাদেশে নারীদের ভূমিকায় যে পরিবর্তন এসেছে, চুয়াডাঙ্গার তরুণী মেরিনা জামান ও তার বান্ধবীদের উদ্যোগ সেটাই বলে দেয়। মেরিনা ও তার ৯ বান্ধবী মিলে গড়ে তুলেছেন বাণিজ্যিক কৃষি খামার। তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম ফ্রেন্ডস অ্যাগ্রো পানেট। সেখানে ড্রাগন, আগর, কমলা, পেয়ারা, তরমুজ, মরিচ, গ্রীষ্ম ও শীতকালীন সবজি, বেগুন, পেঁপে, চিচিঙ্গা, আলুর চাষ হয়ে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গা জেলা কার্যালয় থেকে তৈরি তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে মেরিনার নাম। মেরিনা বলেন, পেশা হিসেবে কৃষি বেশ চ্যালেঞ্জিং। খামারে উৎপাদন, সংগ্রহ, প্যাকেজিং এবং বাজারে নিয়ে ও অনলাইনে বিক্রির পাশাপাশি নিজেরাও হোম ডেলিভারি করি। তিনি বলেন, আমাদের খামারে অর্গানিক পদ্ধতিতে ফল ও ফসল উৎপাদন করা হয়। জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়।
এফএওর প্রতিবেদনটি এবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। দুই প্রতিবেদনেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কৃষি খাত ও বৈশ্বিকভাবে সামগ্রিক কৃষি খাতে নারীর ভূমিকাকে আমলে নেওয়া হয়েছে। এ খাতে নারীর ভূমিকা ও তাতে কতটুকু পরিবর্তন এসেছে, তা তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের নারীরা ঐতিহাসিকভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। ফসল কাটার পর তা মাড়াই, রক্ষণাবেক্ষণসহ বেশির ভাগ কাজ তারাই করে থাকেন। কিন্তু পরিবারের নেতৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের ভূমিকা থাকে কমই। গত কয়েক যুগে পরিবারে নারীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বাংলাদেশের কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কেন বাড়ছে, কারণ-ই বা কী এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর এফএওর ওই প্রতিবেদনে নেই। এফএওর প্রতিবেদনে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গ্রামীণ নারীদের প্রতি বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, বিশ্বে বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীরা সবচেয়ে কম ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করেন। মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশের মোট ৬৪ শতাংশ গ্রামীণ নারী মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। পুরুষের ক্ষেত্রে এই হার ৮১ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১৪ শতাংশ নারী ও ৩০ শতাংশ পুরুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারে নারী-পুরুষ বৈষম্য ৫৫ শতাংশ। পাকিস্তানে ১৫ শতাংশ নারী ও ভারতে ২৪ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি দেশের অবস্থান বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা ওপরে। ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে আছে মেক্সিকো। ওই দেশের ৬৩ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। সেদেশে এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য মাত্র ১২ শতাংশ। মূলত ২০২১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারের তথ্য প্রতিবেদনটিতে ব্যবহার করা হয়েছে। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলাদেশের নারীরা বড় কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তবে তারা যেখানেই সুযোগ পাচ্ছেন, সেখানেই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কৃষিপ্রধান পরিবারগুলো নিয়ে করা দুটি গবেষণার উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কৃষি পরিবারে নারীরা প্রধান হয়ে উঠেছেন, সেখানে ভিন্ন ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। সেসব পরিবারে মেয়ে শিশুরা বেশি পরিমাণে পুষ্টি পাচ্ছে। নারীরা পরিবারের দায়িত্ব পেলে তারা আয়ের একটি অংশ দিয়ে পরিবারের সবার জন্য পুষ্টিকর খাবার বাড়িয়ে দেন। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, পুরুষপ্রধান পরিবারে সবচেয়ে বেশি পুষ্টিকর খাবার পায় ছেলেশিশুরা। কৃষি খাতে নারীর কাজকে আর্থিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। অর্থাৎ তারা পারিবারিক কৃষির অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেও বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক পান না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষিকাজে নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বাড়িয়েছেন। যে কারণে অন্যান্য খাতেও তাদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শুধু উৎপাদন নয়, কৃষিপণ্য বাজারে পৌঁছানো এবং বিক্রিসহ সব কাজে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে কৃষি খাতে নারী উদ্যোক্তা তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ ও সহায়তা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান ৫৩ শতাংশ হলেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। গ্রামাঞ্চলের নারীরা প্রতিদিন গৃহস্থালী যাবতীয় কাজকর্মের পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে পারিবারিক দায়িত্ব হিসেবে কৃষিকাজে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছেন সবসময়। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে অতীতের মতো কৃষির দাপট নেই, কিন্তু তারপরও গ্রামীণ অর্থনীতি এখনও কৃষিনির্ভর। কৃষি কাজে পুরুষের চেয়ে গ্রামীণ নারীর অবদান তুলনামূলকভাবে বেশি। কিন্তু এরপরও নারীদের কৃষক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কোনো স্বীকৃতি নেই। কৃষিতে নারীর অবদানকে অবৈতনিক পারিবারিক শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে সাধারণত। যদিও নারীরা খামার ও পরিবারের উৎপাদন কাজের জন্য দ্বিমুখী চাপ সহ্য করেন।
গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে প্রায় দেড় কোটি বাড়তি শ্রমশক্তি নতুন যোগ হয়েছে। যার অর্ধেকেই নারী শ্রমিক। গ্রামীণ অর্থনীতিতে শ্রমশক্তি হিসেবে নিয়োজিত নারীরা মূলত কৃষিকাজ গবাদিপশু পালন, হাঁসমুরগি পালন, মৎস্য চাষ, শাকসবজি-ফলমূল উৎপাদন ইত্যাদি কৃষিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত। গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করে রাখা নারীদের অবদানের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন করা হয় না আলাদাভাবে। রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অংশ হিসেবে কৃষক কার্ড বিতরণ করা হলেও নারী কৃষকরা সেখানে অবহেলিত এবং বঞ্চিত রয়ে গেছেন বারবার। নারী কৃষিশ্রমিকদের প্রতি মজুরি বৈষম্য আজও অব্যাহত রয়েছে। যদিও নারী শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশই কৃষি উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবচেয়ে বড় কথা, ভূমি মালিকানায়ও নারীর সমঅধিকার নেই। বাজারে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রেও পদে পদে তাদের নানা বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়। প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৃষিতে নারীর অবদানকে অবহেলা করার সাধারণ প্রবণতা থেকেই কৃষিতে নারীর অবদান স্বীকৃতি লাভ করছে না। আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে নব্বইয়ের দশক ও তার পরে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা কমে এলেও কৃষি খাতে নারীর এ অবদানের কারণে সার্বিকভাবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে নারীর অবস্থান আজও শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।
গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে কৃষিকাজে নিয়োজিত বিশাল সংখ্যার নারীদের কাজের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের অবদানকে পৃথকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। স্রেফ পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি একজন নারী কৃষিকাজে তার মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে পরিবার তথা সামগ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন। এর বিনিময়ে তার উপযুক্ত আর্থিক মূল্য প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং শক্তিশালী করার কোনো উদ্যোগ নেই। যার মাধ্যমে নারী তার আর্থিক সক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে উদ্বুদ্ধ হবেন স্বাভাবিকভাবেই। আর্থিক সেবা কার্যক্রমগুলোতে বর্তমানে গ্রামীণ নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবে অনেক কম বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটাকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। শুধু কৃষি খাতে নয়, গ্রামীণ নারীরা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় (এসএমই) ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারেন। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীরা কৃষির পাশাপাশি তাদের সক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে পারেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায অংশগ্রহণের মাধ্যমে। শুধু উৎপাদন কাজে শ্রম দেওয়া এবং অকাতরে অবদান রাখার পরও আর্থিক কর্মকাণ্ডে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়ার ব্যাপারটি এভাবে চলতে থাকলে প্রকারান্তরে নারীরা তাদের মেধা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়তে পারেন। যা গ্রামীণ নারীদের ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেমন সুফল বয়ে আনবে না, তেমনিভাবে টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হবে বারবার।