ডেঙ্গি সংক্রমণের বিষয়ে সতর্ক থাকুন!

ডেঙ্গি সংক্রমণের বিষয়ে সতর্ক থাকুন!

ডেঙ্গি সংক্রমণের বিষয়ে সতর্ক থাকুন!

ডা. মো. তারেক ইমতিয়াজ (জয়)

করোনার প্রকোপ যখন কমতে শুরু করেছে তখন আমাদের দেশে নতুন আতংক হিসেবে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গি। গত কয়েক সপ্তাহে আমাদের দেশে গড়ে করোনা আক্রান্ত রোগীর চেয়ে ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি পাওয়া যাচ্ছে এবং ডেঙ্গিতে মৃত্যুর হার করোনায় মৃত্যু হাড়ের চেয়ে কিছুটা বেশি। শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কোনো বয়সেই ডেঙ্গি হতে পারে। সুতরাং, ডেঙ্গি নিয়ে আমাদের সতর্ক হবার সময় এসেছে।

ডেঙ্গি কি?

ডেঙ্গি একটি মশাবাহিত রোগ, যা ডেঙ্গি ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। এই ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। যথা: DEN-1, DEN-2, DEN-3, DEN-4। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে যে ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব চলছে তা মূলত এই DEN-4 দিয়ে হচ্ছে। আমাদের দেশে সাধারণত জুন-জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গির সংক্রমণ শুরু হয় এবং তা অক্টোবর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তবে গত কয়েক বছরের পরিসংখানে দেখা যাচ্ছে যে আমাদের দেশে এই ডেঙ্গির সংক্রমণ নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে।

ডেঙ্গির বাহক

এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গি ছড়ায়। এডিস মশার দুটি প্রজাতি Aedes aegypti এবং Aedes albopictus মূলত এরাই ডেঙ্গি ভাইরাসের বাহক। মশাগুলোর আকৃতি কিছুটা ছোট। ডেঙ্গি মশা জমে থাকা পরিস্কার পানিতে ডিম পাড়ে। এই ডিমগুলো থেকে সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই লার্ভা বের হয়ে আসে। তবে এই ডিমগুলো শুকনো পরিবেশেও প্রায় একবছর পর্যন্ত জীবন্ত থাকতে পারে। পরবর্তীতে বর্ষার সময় এই ডিমগুলো কখনও যদি আবার পানির সংস্পর্শে আসে তখন ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডিম থেকে লার্ভা বের হয়। শুধু তাই নয়, ডেঙ্গি ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা যে ডিমগুলো পারে সেখান থেকে জন্ম নেওয়া মশায় জন্মগতভাবেই এই ডেঙ্গি ভাইরাসের বাহক হয়।

ডেঙ্গির উপসর্গ

হঠাৎ করে জ্বর দিয়ে এই ডেঙ্গি রোগের উপসর্গ শুরু হয়। জ্বর সাধারণত প্রথম দিন থেকেই বেশি থাকে। জ্বর ১০২ থেকে ১০৫ ডিগি« ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে। জ্বর সাধারণত দুই থেকে সাত দিন থাকে। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ খেলেও তাপমাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে নামে না। জ্বরের সাথে তীব« মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা থাকে। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে চোখের পিছনে ব্যথা থাকে। অর্থাৎ চোখ ডানে-বায়ে ঘোরালে চোখ ব্যথা করে। শরীর ব্যথা অনেকক্ষেত্রে এতটাই তীব« হয় যে শরীর স্পর্শ করলেও রোগী ব্যথা অনুভব করে। চার থেকে পাঁচ দিন পর শরীরে র্যাস দেখা দেয়। এর পাশাপাশি বমি, খাবারে অরুচি, দুর্বলতা, পেটে ব্যথা এসব উপসর্গও থাকতে পারে।

ডেঙ্গির ‘ক্রিটিক্যাল ফেজ’ কী?

অনেক ক্ষেত্রে ডেঙ্গি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির যখন জ্বর কমে যায়, তখন কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। এই সময়কে বলে ‘ক্রিটিক্যাল ফেজ’ (Critical phase). এইসময় দেখা যায় রক্তের প্লেটলেটের সংখ্যা দ্রত কমতে থাকে, রক্তনালী থেকে রক্তের তরল অংশ বের হয়ে যায়, ফলে রক্ত ঘন হতে থাকে, যা রক্তের haematocrit পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায়। রক্তের CBC পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে haematocrit আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। রক্তের তরল অংশ বের হয়ে যাবার কারণে রক্তচাপ কমে যায়, এমনকি রোগী শকে চলে যেতে পারে।

সুতরাং, কোনো ডেঙ্গি রোগীর যখনই জ্বর কমতে থাকবে তার পরবর্তী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় জটিলতার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যদি দেখা যায় যে কোনো ব্যক্তির জ্বর কমে গেছে বা জ্বর ভালো হয়ে গেছে কিন্তু এরপর যদি তার দুর্বলতা আরও বেড়ে যায়, সাথে রক্তচাপ কমে যায়, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, বারবার বমি হয়, পেট ব্যথা থাকে তাহলে তাকে দ্রত হাসপাতালে ভর্তি করে শিরা পথে স্যালাইন দিতে হবে অন্যথায় রোগীর শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে, এমনকি জীবনহানিও ঘটতে পারে। 

চিকিৎসা

জতিলতা দেখা না দিলে ডেঙ্গির চিকিৎসা বাড়িতে বসেই নেওয়া সম্ভব। এই সময় পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। প«তিদিন ন্যুনতম ৬ গ্লাস পানি পান করা উচিৎ। পানি ছাড়াও তরল হিসেবে ফলের রস, ডাবের পানি, দুধ, খাবার স্যালাইন ইত্যাদি পান করা যেতে পারে। জ্বর এবং শরীর ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া ক্লোফেনাক জাতীয় ঔষধ বা অন্য কোনো ব্যথার ঔষধ খাওয়া যাবেনা। জ্বরের জন্য ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা পরপর ১-২ টি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়া যাবে। জ্বর যদি বেশি থাকে সেক্ষেত্রে প্যারাসিটামল সেবনের পাশাপাশি মাথায় পানি দিতে হবে, কপালে জলপট্টি দিতে হবে, বা শরীর স্পঞ্জ করে দিতে হবে।

প্রতিরোধ

  • বাড়ির আশপাশে, বারান্দায়, ছাদে অথবা ঘরের ভিতরে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডেঙ্গি মশা যেখানে জন্মায় সে তার আশপাশে সাধারণত এক কিলোমিটারের মধ্যে বিচরণ করে। সুতরাং, আমরা প«ত্যেকেই যদি আমাদের আশপাশে পানি জমতে না দেবার বিষয়ে সচেতন থাকি তাহলে এই ডেঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
  • অনেক বাড়িতে সার্ভেন্ট টয়লেট থাকে যা অনেক সময় অব্যবহৃত থাকে। সেই কমোডে জমে থাকা পানিতেও ডেঙ্গি মশা ডিম পারতে পারে। সেজন্য এরকম অব্যবহৃত কোনো টয়লেট থাকলে তা প্রতিদিন একবার করে ফ্ল্যাশ করা উচিৎ।
  • বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় আগাছা এসব পরিষ্কার করতে হবে।
  • ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে।
  • মশা যেন কামড়াতে না পারে সেজন্য ফুলস্লিভ জামা পরিধান করা যেতে পারে, মশার কয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে।

[লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য); সহকারী রেজিস্ট্রার, শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।]

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *