বর্তমান বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক অমর মিত্র। জন্ম ১৯৫১ সালের ৩০ আগস্ট, বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ। বর্তমানে তিনি বসবাস করছেন কলকাতা শহরে। ১৯৭৪ সালে ‘মেলার দিকে ঘর’ গল্প নিয়ে বাংলা সাহিত্যে তার আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস ‘নদীর মানুষ’ ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। প্রথম গল্পের বই ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কার পেয়েছেন। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক ‘ও হেনরি’ পুরস্কারে ভূষিত হন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট সাইফুর রহমান লেখালেখিতে প্রবেশ ১৯৭৪ সালে ‘মেলার দিকে ঘর’ গল্পের মাধ্যমে। গল্পে দেখা যায়, লক্ষীর পদচিহ্ন পড়ছে ধুলার ওপরে। লক্ষী গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওই রূপকল্পে। কিন্তু সবাই জানে সে তো যাচ্ছে মেলা দেখতে। আপনি বলছেন, মাইনোলজি কিংবদন্তি, লোক উৎসব, লোকশ্রুতি আপনাকে আকর্ষণ করে?
-তার আগেও আমি গল্প লিখেছি। ‘মেলার দিকে ঘর’ বলতে পারেন প্রথম সাড়া জাগানো গল্প। মিথোলজি আমি পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করিনি। এ পুরাণ-প্রতিমা স্বাভাবিকভাবে এসেছিল।
প্রথম উপন্যাস ‘নদীর মানুষ’। ধুলিহর গ্রামের পার্শ্ববর্তী কপোতাক্ষ নদ, যে নদের কথা আপনার মাও শোনাতেন আপনাকে। আর শোনাতেন নদীতে ভাসমান অলৌকিক সেই জলযানদের কথাও… আপনার স্মৃতিকথায় এসব নদীর বিষয় এসেছে।
-এ নদী কপোতাক্ষ নয়। সুবর্ণরেখা। কপোতাক্ষ, আমি প্রথম দেখেছি ২০০০ সালে। ১৯৭৭ সালে লিখেছিলাম প্রথম উপন্যাস ‘নদীর মানুষ’। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে অমৃত পত্রিকার বিনোদন সংখ্যায় তা ছাপা হয়েছিল। অমৃত সম্পাদক ছিলেন লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তার আগে উপন্যাস লেখার কথা ভাবিওনি।
সেই উপন্যাস লেখার কথাই বলি। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে আমি মেদিনীপুর জেলার গোপীবল্লভপুর থানার এক দুর্গম এলাকায় বদলি হই। তখন সারা ভারতে জরুরি অবস্থা। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের হাতে অনেক ক্ষমতা। সেই পোস্টিং ছিল অনেকটাই শাস্তিমূলক, আবার আমার কাছে আশীর্বাদস্বরূপও। ইউনিয়ন করার কারণে সেই দূরবর্তী অঞ্চলে পাঠানো। আমি ভূমি রাজস্ব বিভাগের কানুনগো ছিলাম। গ্রামে ছিল অফিস, হল্কা ক্যাম্প। কিন্তু সেই গ্রামে উপযুক্ত বাড়ি ছিল না, দোকানপাট ছিল না, তাই ক্যাম্প হয় বংশীধরপুরে। বংশীধরপুর অনেক দূর। ১৯৭৫-এর ডিসেম্বরে গিয়ে ১৯৭৬-এর ডিসেম্বরে চলে এসে আর যেতে পারিনি সেই গ্রামে। কিন্তু যতদিন ছিলাম বংশীধরপুরে, পনেরদিন অন্তর বা মাসান্তে কলকাতা এসে আবার ফিরে যেতে হতো। ফিরে যেতে কত কষ্ট! কলকাতা থেকে কেওনঝোড়-বারিপদা (ওড়িশা)-র পথে জামশোলা ব্রিজ বাসে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। বাবুঘাট থেকে ছাড়ত সেই বাস। তখন ছ’নম্বর জাতীয় মহাসড়ক ছিল এখনকার চেয়ে দুই তৃতীয়াংশ কম চওড়া। ভাঙাচোরা। জামশোলা ব্রিজ সুবর্ণরেখা নদীর ওপরে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার (এখন ঝাড়খণ্ড) ও ওড়িশা মিলেছে। ব্রিজ থেকে পুবে বংশীধরপুর হেঁটে অনেকটা পথ। কিন্তু পথ বলতে ছিল না। জামশোলা ব্রিজ জায়গাটি ওড়িশার ভেতরে পড়ে। এখান থেকে বাম দিকে অর্থাৎ পুবে বাংলা। উত্তর পশ্চিমে হাইওয়ে ছুটে গেছে ওড়িশার বারিপদার দিকে। পুবে শাল জঙ্গল, সেই জঙ্গলের ধারে সুবর্ণরেখা। তার দুই তীর প্রস্তরাকীর্ণ। জায়গাটির নাম হাতিবাড়ি। হাতিবাড়ি এখন ভ্রমণকারীদের কাছে প্রিয় জায়গা।
জামশোলা ব্রিজ থেকে বংশীধরপুর যেতে ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট হাঁটতে হতো। ওই দূরে মৌভাণ্ডার গ্রাম টিলা, তারপর আবার জঙ্গল। ডানদিক দিয়ে সুবর্ণরেখা নদী বয়ে যাচ্ছে। নদী জামশোলা হাতবাড়ি থেকে নেমে এসেই ছড়িয়ে গেছে দুদিকে। মস্ত তার বিস্তার। দুই দিকে দু’হাত ছড়িয়ে দিয়েছে যেন। জল অনেকটা দূরে, মস্ত বালুচর পার হয়ে যেতে হয়। বংশীধরপুরে গিয়ে গ্রামের দেবতা বংশীধর ঠাকুরের কথা শুনি আমি। সে এক অলৌকিক গল্প। বংশীধর ঠাকুরের মন্দির ছিল গাঁইয়ে। প্রতি পূর্ণিমায় বংশীধর কৃষ্ণ বাঁশি হাতে গ্রাম পরিক্রমায় বের হন। সেই বাঁশির সুরে কুমারী, বিবাহিতা সব কন্যা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। পূর্ণিমায় তাই মেয়েদের সাবধানে রাখতে হয় রাতে। কোনো পূর্ণিমায় আমি শুনিনি অবশ্য বাঁশির সুর। পুরুষ বলে কী? উপন্যাস সেই গ্রাম নিয়ে আর সুবর্ণরেখা নদীর ষাটিদহ নিয়ে।
হাতিবাড়ির সুবর্ণরেখা খুব গভীর নদী। ষাট হাত জল সেখানে। পুরাকালে এ অঞ্চলের রাজা যাবতীয় অনাচারে রুষ্ট হয়ে সুবর্ণরেখার ভেতরে নেমে গিয়েছিলেন তার প্রাসাদ নিয়ে। কিন্তু রাজা তো প্রজাবৎসল ছিলেন। তাই নদীতে বান এলে, পশিমের জল নেমে এলে বন্যার হাত থেকে প্রজাদের বাঁচাতে জলের নিচে প্রাসাদে ঘণ্টা বাজিয়ে দিতেন। বন্যার সময় নাকি সেই ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়। আমার প্রথম উপন্যাস, ‘নদীর মানুষ’ এ বংশীধরপুরের পটভূমিকায় লেখা। সেখানে হাতিবাড়ির ষাটিদহর পুরাণ-কথা ব্যবহার করেছিলাম।
জন্ম সাতক্ষীরার ধুলিহর গ্রামে। পরবর্তীকালে আপনারা পশ্চিমবঙ্গ চলে যান। আপনাদের দেশত্যাগ, দেশভাগ নিয়ে কিছু বলুন: আমার বাবা দেশভাগের আগে বাংলা সরকারে চাকরি করতেন। স্বাধীনতা এলে বাবা ভারত সরকারের পক্ষে মতদান করেন। ১৯৪৭-এর কথা তা। ফলে আমাদের পাকিস্তান ত্যাগ করতেই হয়। সাতক্ষীরার লাগোয়া বসিরহাটে আমরা বসত করি। আমার কাকা ওপারে থেকে যান। তিনি ১৯৬২ সালে দেশ ছাড়েন। আমাদের যাওয়া-আসা ছিল। দেশভাগ নিয়ে যা আমার স্মৃতি তা আমার মায়ের স্মৃতি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র। আপনিও। সেজন্যই বলছি। মানিক বন্দোপাধ্যায় তার পূর্বসূরি সাহিত্যিকদের পড়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সাহিত্যে বাস্তবতা আসে না কেন, সাধারণ মানুষ ঠাঁই পায় না কেন সাহিত্যে? মানুষ হয় ভালো, নয় তো মন্দ হয়। ভালো-মন্দ মেশানো হয় না কেন? শরৎচন্দ্রের চরিত্রগুলোও হৃদয়সর্বস্ব কেন, হৃদয়াবেগ কেন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে-বিশেষ করে মধ্যবিত্তের হৃদয়। আমার প্রশ্ন, আপনার সাহিত্যে বাস্তবতা কীভাবে এসেছে?
-আমার সাহিত্যে কীভাবে কী এসেছে তা বলবেন পাঠক। সমালোচক। আমি মনে করি, আঁকাড়া বাস্তবতা এক জায়গায় গিয়ে থেমে যায়। কল্পনা এবং বাস্তবতা দুইয়ের ভেতরে আমি চলাফেরা করতে ভালোবাসি। মানুষের অন্তর্গত রহস্য উদ্ধার করতে চেয়েছি যেমন, তেমনি চেয়েছি শিকড়ে পৌঁছতে।
মানিক বন্দোপাধ্যায় বলেছেন-‘সাহিত্যিক হতে হলে বাস্তব জীবনের মতো সাহিত্যকেও অবলম্বন করতে হয়। সাহিত্য না ঘেঁটে, নিজের জানা জীবন সাহিত্যে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, নিজে যাচাই করে না জেনে এবং প্রতিফলনের কায়দা-কানুন আয়ত্ত না করে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। সাহিত্য-সমালোচক হওয়া যায় কিনা তাতেও আমার সন্দেহ আছে! জীবনকে তো জানতেই হবে, এ বিষয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জীবনকে জানাই যথেষ্ট নয়। সাহিত্য কী এবং কেন সে তত্ত্ব শেখাও যথেষ্ট নয়। যে জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছি বুঝেছি, সেই জীবনটাই সাহিত্যে কীভাবে কতখানি রূপায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে, সেটাও সাহিত্যিককে স্পষ্টভাবে জানতে ও বুঝতে হবে, নইলে নতুন সৃষ্টির প্রেরণাও জাগবে না, পথও যুক্ত হবে না।’ এ কথাগুলো সঠিক মনে করেন?
-মানিক বাবুর কথা সত্য, কিন্তু সাহিত্যে শেষ কথা হয় না। সাহিত্যের সব মত ও পথ মুক্ত থাকাই ভালো। এক একজন লেখক এক এক রকম ভাবেন। আমি অত তত্ত্ব কথা ভেবে তো লিখিনি। কিন্তু জীবন দেখেছি। জীবনকে ভালোবেসেছি। ভালোবেসে অশ্রুপাত করেছি। আবার উদ্দীপ্ত হয়েছি। লেখায় তার ছায়া পড়েছে।
আর্ট ফর আর্ট সেক (অৎঃ ভড়ৎ অৎঃ ঝধশব) অর্থাৎ শিল্পের জন্য শিল্প এ মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না মহামতি সাহিত্যিক লিও তলেস্তয়। তার মতে, সাহিত্য হবে জীবনের জন্য তার এ মতবাদের সঙ্গে আপনি কতটা একমত?
-নিশ্চয়ই। জীবনের সঙ্গে জীবনের যোগই সাহিত্য। আমি শিল্পের জন্য সাহিত্য, এ মতবাদের বিরোধী।
অশ্বচরিত লিখতে আপনার লেগেছিল ১৭ বছর। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো তার ‘লা মিজেরেবল’ উপন্যাসটি লিখতে সময় নিয়েছিলেন ১২ বছর। আসলে ১২ বছর বললেও ভুল বলা হবে। ১৮৩০ সালের দিকে হুগো পরিকল্পনা শুরু করেন উপন্যাসটি কীভাবে লিখবেন তিনি। লেখা শুরু করেন ১৮৪৫ সালে এবং শেষ করেন ১৮৬২ সাল নাগাদ। আরেক বিখ্যাত লেখক টলকিন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘লর্ড অফ দ্য রিং’ লিখতে সময় নেন ১৭ বছর। বাংলাসাহিত্যে তেমন কাউকে দেখা যায় না এত সময় নিয়ে উপন্যাস লিখতে। আপনার ক্ষেত্রে এমনটা কেন হলো যদি বলতেন-
১৯৮০ নাগাদ, তখন তিরিশে পৌঁছইনি, একটি নভেলেট লিখেছিলাম শিলাদিত্য পত্রিকায়। সম্পাদক ছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। ‘বিভ্রম’ ছিল সেই নভেলেটের নাম। একটি ঘোড়ার গল্প। দীঘার সমুদ্রতীরের এক হোটেলওয়ালার একটি ঘোড়া ছিল। ঘোড়াটি প্রতি আশ্বিনে পালায়। সুবর্ণরেখা এবং সমুদ্রের মোহনার কাছে বড় একটি চর ছিল। আশ্বিনে সেই চরে চারদিক থেকে ঘোটক ঘোটকীরা পালিয়ে আসে সবুজ ঘাস এবং প্রেমের নেশায়। ঘোড়া এবং ঘুড়িদের ভেতর ভালোবাসা হয় সেই সময়। কিন্তু সেই বছর বৈশাখে সে অদৃশ্য হয়েছিল। নিখোঁজ সেই ঘোড়া খুঁজতে যায় হোটেলওয়ালার আশ্রিত ভানু দাস। মধ্যবয়সি ভানু ছিল হা-ঘরে। দুনিয়ায় কেউ কোথাও ছিল না তার। আমি দীঘায় কর্মসূত্রে গিয়েছিলাম শীতের সময়। ১৯৭৯-র ডিসেম্বর মাসে। একটি হোটেলে মাস-চুক্তিতে আমি ঘর ভাড়া করেছিলাম। সেই হোটেলের মালিকেরই ছিল ঘোড়াটি। দেখতাম আমার ঘরের জানালার ওপারে নিঝুম বেলায়, নিঝুম রাতে ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। ভানু কোথায় যেত ঘোড়াটির খোঁজে তা জানা যেত না। রাহা খরচ নিত গাঁজাড়ু হোটেলওয়ালার কাছ থেকে। মনে হয় ঘোড়া খোঁজার নাম করে সে নিজের একটা ইনকামের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু ভানু আশ্চর্য সব জায়গার নাম করত হঠাৎ হঠাৎ। মীরগোদার জাহাজ ঘাটার দিকে দেখা গেছে নাকি একটি ঘোড়া। রানিসাই গ্রামের একজন খবর দিয়েছে সেদিকে একটি ঘোড়া দেখা গেছে। যাই হোক, ভানুর সঙ্গে আমিও ঘোড়া খুঁজতে গিয়ে নুনের খালারি দেখে এসেছিলাম। কিন্তু যে কথা বলতে চাইছি, আশ্বিনে যার পলায়নের কথা, সে বৈশাখে কেন পালিয়েছে? গেল কোথায় সেই বুড়ো টাট্টু? ভানু জানে না। লেখক জানবে কী করে?
বাস্তবতা ছিল ঘোড়াটি নিখোঁজ হয়েছে। কিন্তু কেন তা কেউ বলতে পারছে না।
জীবনের অনেক রহস্য খুঁজে বের করা যায় না সত্য। অনেকেই তা প্রকাশ করেন না। লেখক তো তৃতীয় নয়নের আধিকারী, তিনি সেই রহস্য কি উন্মোচন করতে পারবেন না! আমি ভানুকে কতবার জিজ্ঞেস করেছি তার অশ্ব কেন নিরুদ্দেশে গেল। হোটেলের ঠাকুর বলল, কেউ হয়তো চুরি করে নিয়ে গেছে। সোজা কথা। এতে করে নিরুদ্দেশের রহস্য শেষ হলো। কিন্তু ভানু দাস আমাকে বলেছিল, না দাদা, বুড়ো ঘোড়াকে কে চুরি করবে? তাহলে সে পালাল কেন, এখন তো আশ্বিন নয়?
ভানু উত্তর দিতে পারেনি। পরের ডিসেম্বরে আমি চলে আসি দীঘা থেকে। তখনো রাহা খর্চা নিয়ে ভানু সেই পলাতককে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। বদলি হয়ে চলে আসার পর আমার ভেতরে প্রশ্নটি ছিল, সে পালিয়েছিল কেন বৈশাখে? আশ্বিনের বদলে বৈশাখে কেন? উত্তর নেই। আমি উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম নিজের ভেতরে। নভেলেট লিখতে আরম্ভ করেছিলাম সেই ঘোড়াটিকে নিয়ে। সেই সময়েই যেন স্বপ্নোত্থিতের মতো এক ভোরে আমি লিখতে বসে পেয়ে গিয়েছিলাম পলায়ন রহস্য। সে ছিল যেন প্রকৃতি এবং জীবনের রহস্য উদ্ধার।
সেদিন ছিল ভয়ানক বৈশাখ। ঘোড়ায় চেপে ঘোড়ার মালিক ফিরেছিলেন গ্রাম থেকে দীঘায়। রোদে ঘোড়াটির জিভ বেরিয়ে এসেছিল। সে দাঁড়িয়েছিল একটি নিমগাছের ছায়ায়। নবীন তরুর ছায়া ছিল না বেশি। ফলে বৈশাখের রোদে পুড়ছিল। গরম বাতাস বইছিল। বালিয়াড়ি তেতে গিয়েছিল ভীষণ। ঘোড়াটি ধুঁকছিল। এরপর দুপুরের শেষে আকাশের ঈশেন কোণে মেঘের সঞ্চার হয়। ধীরে ধীরে ঘন কালো মেঘ ছেয়ে ফেলে সব আকাশ। সমুদ্র দিগন্ত থেকে মেঘ উঠে আসতে থাকে ওপরে। ঘোর অন্ধকার হয়ে আসে। ঝড় এলো। তারপরই বৃষ্টি। প্রবল বর্ষণে ভেসে যায় সব। উত্তাপ অন্তর্হিত হলো। বৃষ্টি থামে ঘণ্টা দেড়ের পর। সন্ধ্যে হয়ে আসে। সবদিক ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঘোড়াটি বৃষ্টিতে ভিজেছে কত। ঠান্ডা হয়েছে শরীর। আরাম হয়েছে তার। সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। সন্ধ্যের পর চাঁদ উঠল। আশপাশের বালিয়াড়ির ধারের গর্তে, রাস্তার কোথাও কোথাও জল জমেছিল। রাত হলে চাঁদ আকাশের মাথায় উঠে এলে জোছনা পড়ল জমা জলে। আকাশে দেখা গেল পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে চলেছে নিরুদ্দেশে। ঘোড়াটি অবাক হয়ে আকাশ মাটি দেখল। বাতাসে ঘ্রাণ নিল। তার মনে হলো আশ্বিন-শরৎকাল এসে গেছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছিল ভয়ানক গ্রীষ্ম। দুপুরের শেষে এল বর্ষা। তারপর আশ্বিনের পূর্ণিমা। শরৎকাল। একই দিনে দুই ঋতু পার করে আশ্বিনে এসে গেছে সে। সুতরাং, চলো নিরুদ্দেশে। সেই যে সুবর্ণরেখার মোহনায় চর জেগেছে সবুজ ঘাস নিয়ে, সেখানে এসে গেছে ওড়িশার ভোগরাইয়ের ঘুড়ি, আগের বছর তার সঙ্গে প্রেম হয়েছিল তার। মিলন হয়েছিল। সে খুটো উপড়ে পালাল এ বিভ্রমে। সারারাত ছুটেছিল সে জোছনার ভেতর দিয়ে। সকাল থেকে ফিরে এলো বৈশাখ। রোদ তেতে উঠতে লাগল। সে টের পেল আর ফেরার উপায় নেই। ভয়াবহ গ্রীষ্ম ফিরে এসেছে। বিভ্রম হয়েছিল। বিভ্রমে সেসব রাত ধরে মৃত্যুর দিকে ছুটেছে। অশ্বচরিত উপন্যাসের খসড়া ছিল এই। ১৯৮১-র ফেব্রুয়ারিতে শিলাদিত্য পত্রিকায় ছাপা হয় ‘বিভ্রম’ নামের যে নভেলেট, তা ১৭ বছর পরে হয়েছিল অশ্বচরিত।
বিভ্রম নভেলেট প্রকাশিত হলে অনেকের ভালো লেগেছিল। অচেনা লেখকের লেখা ছেপেছিলেন সুধীর বাবু পাণ্ডুলিপি পড়ে। আমার তখন একটি-দুটি বই বের হচ্ছে। কিন্তু বিভ্রম নিয়ে আমার ভেতরে দ্বিধা ছিল। মনে হতো আরও কিছু লেখার আছে। আমি লিখতে পারিনি। বছর সাত বাদে ১৯৮৮ নাগাদ আমি আবার লিখতে আরম্ভ করি উপন্যাসটিকে। সামনে সেই নভেলেট। লিখেছিলাম। এক প্রকাশকের হাতে দিয়েছিলাম প্রকাশের জন্য। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্য, তিনি পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছিলেন। মনে হয়েছিল বিভ্রম আর বই হয়ে বের হবে না। ‘বিভ্রম’ আমার মাথার ভেতরে একটি কাঁকর ফেলে দিয়েছিল। আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম না নভেলেটটি নিয়ে। পড়েই থাকল আরও দশ বছর। ১৯৯৭-এ রাজস্থানের মরুতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের পর আমি আবার নভেলেটটিকে সামনে রেখে নতুন উপন্যাস লিখতে শুরু করি। বিস্ফোরণের দিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। আমার ঘোড়াটি পালিয়েছিল সেইদিনই। আমি তা ১৯৮১ সালেই লিখেছিলাম। এ ১৭ বছরের মাথায় সেই বুদ্ধ পূর্ণিমাই হয়ে গেল পথ। রাজপুত্র গৌতমের অশ্ব কন্থক হয়ে গেল সেই বুড়ো টাট্টু। ভানু হয়ে গেল গৌতমের সারথি ছন্দক। তারা তপোবনে দিয়ে এসেছিল রাজপুত্রকে। তিনি ফিরবেন এ হিংসার পৃথিবীতে। ভগবান বুদ্ধ ফিরবেন। সারথি ছন্দক আর অশ্ব কন্থক অপেক্ষা করছে তার জন্য এ সময়ে। সময় ১৯৯৮। রাজপুত্র ফিরে এলে পৃথিবী হিংসা মুক্ত হবে। পলাতক ঘোড়া বিভ্রমে পড়েছিল। বিভ্রম তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। ছুটতে ছুটতে সে হিরোশিমায় গিয়ে পড়ে। সেখানে তখন কালো বৃষ্টি।
অশ্বচরিত লিখতে ১৭ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। লেখক নিজেই বোঝেন লেখা হয়েছে কী হয়নি। তিনি নিজেই নিজের পাঠক। নিজের জন্যই প্রথমে লেখেন।
… মূল কথা হলো বিষয় নির্বাচন-নতুন কিছু না দিলে পাঠক ছুড়ে ফেলে দেবে। পড়তে পড়তে পাঠক যদি হাসে, মজা পায়, তা হলেই কাজ হাসিল। সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের এ কথার সঙ্গে আপনি কতটা একমত?
-আমি এ বিষয় নিয়ে ওঁর জীবিতকালেও কিছু বলিনি। অহেতুক উনি আক্রমণ করেছিলেন আমাকে। কে হারিয়ে যাবে, কে যাবে না, তা তো মহাকালের কথা। আমি যেমনই লেখক হই, ওঁর পরামর্শে লিখতে যাব কেন। আমি লিখেছিলাম অশ্বচরিত। সেই উপন্যাস ভালো না মন্দ সে কথা বলবে পাঠক। ২৫ বছর পার হয়ে গেছে, ওই উপন্যাস তো এখনো নতুন প্রজন্ম পড়ছে। আমি রুশ উপন্যাস, দেবেশ, শ্যামল, অমিয়ভূষণ পড়ে উপন্যাস লিখতে শিখেছি। ওঁর উপন্যাস পড়ে নয়। উনি নিন্দা করতে ভালোবাসতেন। সবাই নিজের মতো লিখছেন। কেউ কারও মতো হন না। আর তিনি কী মনে করতেন, এক্সপেরিমেন্ট চলে না ইত্যাদি, তা তার কথা। সাহিত্য নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেই। বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালেই তা ধরা যায়। কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকতে চায় কে?
অনেকেই মনে করেন, বর্তমান প্রজন্ম সাহিত্যবিমুখ; এ ধারনার সঙ্গে আপনি কতটা একমত? আমরা লেখক সমাজ ভালো লেখা উপহার দিতে পারছি না, নাকি সোশ্যাল মিডিয়া ও মোবাইল সংস্কৃতির জন্য বর্তমানে সাহিত্যের পাঠক কমে যাচ্ছে ?
-যদি বিমুখই হয়, এত বই কারা পড়ে। চিরকাল নতুন প্রজন্ম নিয়ে আগের প্রজন্ম-র সমস্যা হয়। এ কথা সেই সমস্যার একটি উদাহরণ। এখন পড়ার ধরন বদলে গেছে। সাহিত্যের পাঠক সাহিত্য পড়ে। আমাদের সময়েও সবাই সাহিত্য পড়ত না। কেউ কেউ পড়ত। এখনো তাই।
দৈনিক যুগান্তর থেকে সংকলিত