দেওয়ানবাগ ডেস্ক: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বে দুর্যোগ বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশ দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষায় বিশ্বে রীতিমতো ‘রোল মডেল’ হয়ে উঠেছে। এবারের সাইক্লোন মোখায় কোনো প্রাণহানি না ঘটায় সে দাবি করতেই পারে বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড় মোখা সুপার সাইক্লোনের রূপ ধারণ করলেও বাংলাদেশে তার বিধ্বংসী রূপ দেখা যায়নি। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিনসহ কিছু কিছু এলাকার ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
কিন্তু কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। শুধু সেন্টমার্টিন দ্বীপে একজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে এটা ঠিক যে, ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ আর শাহ পরীর দ্বীপের মানুষরা। বিশেষ করে গরিব ও নিম্নবিত্তদের কাঁচা ঘরবাড়ি একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এই ঘূর্ণিঝড়ে। সব মিলিয়ে ঝড়ের প্রভাবের শিকার হয়েছেন ৩ লাখ ৩৪ হাজার মানুষ।
তবে, সরকারের সামগ্রিক কার্যক্রমে প্রাণহানি ঘটেনি। মোখার আঘাতে ক্ষতি হতে পারে, এমন জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাইকেই সেখান থেকে সরানো হয়েছিল। জরুরি পরিস্থিতির মাঝেও সাইক্লোন শেলটারগুলোতে খাবার, ওষুধ, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল ভালো। এ থেকে দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ধাপে ধাপে বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের বিস্তৃত উপকূলীয় এলাকায় আধুনিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এবারের মোখা মোকাবিলা এবং তার প্রস্তুতি আমাদের সে প্রমাণ দেয়। এ বিপরীতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় তাদের ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়তে দেখা গেছে।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় আমরা সফল। এবারই প্রথম ঝড় মোকাবিলায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। তার মানে, সরকারের প্রস্তুতি খুব ভালো ছিল। এখন সবাই যার যার বাড়িতে ফিরে গেছেন। যাদের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। ফলে আমাদের প্রস্তুতি বিশ্বের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল হয়ে উঠছে।’
দক্ষিণ আটলান্টিক এবং দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর বাদে পৃথিবীর বাদবাকি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাগরে যে মারাত্মক বায়ুমণ্ডলীয় দুর্যোগ সৃষ্টি হয়, তা সাধারণভাবে ঘূর্ণিঝড় হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে গড়ে ৮০টি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়। বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ভৌগোলিক অবস্থান মৌসুমি বায়ুর সঙ্গে সঙ্গে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী, টর্নেডো ও বন্যাও বয়ে আনে। বঙ্গোপসাগর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য এক আদর্শ ক্ষেত্র। ঘূর্ণিঝড়গুলো সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়, যখন তা বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানে। এর পেছনের কারণগুলো হলো বিস্তৃত নিম্নসমতল ভূমি, জনসংখ্যার ঘনত্বের উচ্চমাত্রা এবং ঘরবাড়ির দুর্বল নির্মাণকাঠামো। সর্বাধিক ক্ষয়ক্ষতি হয় খুলনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে এবং সমুদ্রতীর থেকে দূরবর্তী দ্বীপসমূহ যেমন ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, মনপুরা, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, নিঝুম দ্বীপ, উড়িরচর এবং নতুন জেগে ওঠা দ্বীপসমূহে।
ঘূর্ণিঝড়সংক্রান্ত তথ্যে দেখা যায় যে, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে ঘণ্টায় ৫৪ কিলোমিটারের বেশি গতিসম্পন্ন ১৭৪টি ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তার মধ্যে জানুয়ারিতে একটি, ফেব্রæয়ারিতে একটি, মার্চে একটি, এপ্রিলে ৯টি, মে মাসে ৩২টি, জুনে ছয়টি, জুলাই মাসে আটটি, আগস্টে চারটি, সেপ্টেম্বরে ১৪টি, অক্টোবরে ৩১টি, নভেম্বরে ৪৭টি এবং ডিসেম্বর মাসে ২০টি ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা ঘটে। এ তথ্য থেকে বোঝা যায়, মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়গুলো প্রধানত প্রাক-বর্ষা মৌসুম (এপ্রিল-মে) এবং বর্ষা-উত্তর সময়ে (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর) বেশি ঘটেছে এবং এগুলোই ছিল সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক।
বাংলাদেশে গত কয়েক শ বছরে ৫৩টি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় দেখা দিয়েছে। ১৯৯৭ ও ২০০৭ সালে যে দুইটি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ ও ২০০ কিলোমিটার; কিন্তু মোট মৃত্যু ছিল যথাক্রমে ১২৬ ও ৩ হাজার ৪০৬ জন। আবহাওয়া দপ্তর বলছে, গত ১০ বছরে দেশে মোট পাঁচ থেকে ছয়টি বড় ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। ২০২০ সালে আম্ফান আঘাত হানলে ২৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়; এতে মৃত্যু হয়েছিল ২৬ জনের। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উন্নতি ও সচেতনতার কারণেই জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমে এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ‘মোরা’। ২০১৭ সালের ৩০ মে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ আঘাত হেনেছিল। এর গতি ছিল ঘণ্টায় ১৪৬ কিলোমিটার। এর আগে, ২০১৬ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ আঘাত হানে। এর গতিবেগ ছিল ১২৮ কিলোমিটার। ২০১৩ সালের ১৬ মে আসে মহাসেন, যার গতি ছিল ১০০ কিলোমিটার। আর ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই আসে কামেন। এর গতি ছিল ৬৫ কিলোমিটার। আর ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে আইলা। এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে ২৬০ কিলোমিটার বেগের বাতাসের সঙ্গে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। ঝড়ে ২ হাজার ২১৭ জন প্রাণ হারান। পানির চাপে পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদের পাড়ের বেড়িবাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ৬৮ হাজার ৩৭৯টি ঘরবাড়ি। পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে যায় ৩৭ হাজার ৬৪ একর জমির ফসল। ২০০৯ সালে ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে। ঝড়টির ব্যাস ছিল প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, যা ঘূর্ণিঝড় সিডরের থেকে ৫০ কিলোমিটার বেশি। সিডরের মতোই আইলা প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় নিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। ঝড়ে ১৯৩ জনের মৃত্যু ও ৭ হাজার মানুষ আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ২ লাখ গবাদি পশু মারা যায়।
১৫৮৪ বাকেরগঞ্জ এবং পটুয়াখালী জেলায় আঘাত হানে যে ঘূর্ণিঝড়, তা পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী ছিল। উঁচু স্থানে থাকা মন্দির ছাড়া সবকিছু তলিয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে প্রায় ২০ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। সাম্প্রতিক কালে ১৯৭০ সালের গোর্কি ও ১৯৯১ সালের ম্যারিয়েন ঝড় অন্যতম। এই দুইটি ঝড়ে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল অনেক। ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে গোর্কি আঘাত হানে।
তবে, এ পর্যন্ত হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৭০ সালের গোর্কির ভয়াবহতা ছিল সবচেয়ে বেশি। ঝড়ের কারণে প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এদের বেশির ভাগই জলোচ্ছ¡াসে ডুবে মারা যায়। ঝড়ের মাত্রা ছিল ‘ক্যাটাগরি ৩’। ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২২২ কিলোমিটার এবং জলোচ্ছ¡াসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ৩০ ফুট। ঝড়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তজুমদ্দিন উপজেলা। সেখানকার ১ লাখ ৬৭ হাজার অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ৭৭ হাজারই প্রাণ হারায়। ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়টি ইতিহাসের অন্যতম বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়। এই ঝড়ের ফলে দেশে যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বন্যা হিসেবে পরিচিত। ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রায় ৫ হাজার ৭০৮ জন প্রাণ হারায়। ঝড়ে বাংলাদেশের প্রায় ৭০ ভাগ ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টন।
নিহতের সংখ্যা বিচারে ম্যারিয়েন ঘূর্ণিঝড়টি খুবই ভয়াবহ। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ¡াসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়। এর ফলে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। প্রায় ১ কোটি মানুষ সর্বস্ব হারায়। ঝড়ের মাত্রা ছিল ‘ক্যাটাগরি-৫’। এতে ১ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়ে।