দেওয়ানবাগ ডেস্ক: রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। রোগীর স্বজনরা বলছে, একসঙ্গে পরিবারের একাধিক সদস্যও জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছে। তিন থেকে সাত দিন জ্বর-সর্দি-কাশির তীব্রতা থাকছে। জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শিশু ও বয়স্কের সংখ্যা বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা শিশু হাসপাতালের তথ্য বলছে, বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে রোগী বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া চিকিৎসকদের চেম্বার ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্রগুলোতে জ্বর নিয়ে আসা রোগীর ভিড় বেড়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে ভর্তির প্রয়োজন হচ্ছে ৫ শতাংশের। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরছে। এসব রোগীর মধ্যে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, ব্রংকিওলাইটিস, ডায়রিয়া, সর্দি-জ্বরের রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। পরীক্ষায় ২-৩ শতাংশ করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসুস্থ হওয়ার অন্যতম উপসর্গ জ্বর। সাধারণ জ্বর হলে দু-তিন দিনের মধ্যে এমনি সেরে যায়। জ্বর তিন দিনের বেশি থাকলে চিকিৎসাসেবা নেওয়াটা বাঞ্ছনীয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন বলেন, ঋতু বদলের কারণে বছরে দুইবার অসুখ বেশি হয়। শীতের শুরুতে ও শীতের শেষে। বিশেষ করে বয়স্ক, শিশু ও দীর্ঘদিন ধরে পুরনো রোগে ভোগা ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। এ সময় তাদের ভাইরাস জ্বর, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক সংক্রমণের কারণে ফুসফুসের নানা রোগ হয়ে থাকে।
ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন বলেন, বাতাসে আর্দ্রতা কমে শুষ্কতার কারণে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু শ্বাসনালি ও ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। এ জন্য রোগীকে বেশি করে পানি পান করাতে হবে এবং পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। জ্বর হলে কোনো অবস্থায় অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি যারা, বিশেষ করে যাদের শ্বাসতন্ত্রের রোগ আছে, হার্ট বা কিডনির রোগে ভুগছে, তাদের ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়া প্রতিষেধক টিকা নিতে হবে।
গতকাল ঢাকা শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগে দীর্ঘ লাইনে রয়েছে রোগীর স্বজনরা। ডলি রানী এসেছেন এক বছরের নাতি মিহির দাসকে নিয়ে। বাসায় বড় নাতি অসুস্থ হওয়ার কারণে শিশুটির মা আসতে পারেননি।
ডলি রানী বলেন, ‘দুই নাতির জ্বর। বাসায় যে আছে, তার অবস্থা এখন ভালো। একজনকে নিয়ে এসেছি, ডাক্তার দেখে ভর্তির কথা বলেছেন, কিন্তু এখানে রোগীর সঙ্গে থাকার মতো কেউ নাই।’
হাসপাতালের বহির্বিভাগে ৯ মাসের শিশু মেহমেদকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন বাবা বাহাউদ্দিন। তিনি জানান, এক দিন ধরে সন্তানের জ্বর। ওকে নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় আছেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বহির্বিভাগে এখন গড়ে প্রতিদিন এক হাজার ২০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। অন্যান্য সময় এ সংখ্যা ছিল ৯ শর কম।
হাসপাতালটির চিকিৎসক ডা. এ বি এম মাহফুজ হাসান আল মামুন বলেন, গত সপ্তাহ ধরে রোগী বাড়ছে। বেশির ভাগের জ্বর, ঠাণ্ডা-কাশি, ডায়রিয়া, অ্যাজমা, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, ব্রংকিওলাইটিস, শ্বাসকষ্ট। চর্মের সমস্যাও অনেক বেড়েছে। ২-৩ শতাংশ করোনার রোগী পাওয়া যাচ্ছে।
মাহফুজ হাসান আল মামুন বলেন, বেশির ভাগ শিশুর শুরুতেই তীব্র জ্বর আসছে। ১০৪-১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠছে। সাধারণ জ্বর তিন দিন পর এমনিতেই সেরে যায়। কিন্তু সর্দি-কাশি বা অন্য উপসর্গ থাকছে কারো, জ্বর কমছে না—মূলত তারাই হাসপাতালে আসছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. শেখ আবদুল্লাহ বলেন, বছরের অন্যান্য সময় প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ রোগী আসে। এখন প্রতিদিনের গড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগের জ্বর, ঠাণ্ডা, নিউমোনিয়া। ২ শতাংশ ক্ষেত্রে করোনা।
গতকাল রাজধানীর বাংলামোটর, ধানমণ্ডি, ভাটারা ও তেজগাঁও এলাকার বিভিন্ন ফার্মেসি দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। শিশুদের বিভিন্ন ধরনের সিরাপ বিক্রি বেড়েছে।
ধানমণ্ডির জিগাতলা এলাকার মা ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতা সবুজ মিয়া বলেন, প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধের চাহিদা সারা বছরই থাকে। তবে এখন যেহেতু মানুষের মৌসুমি জ্বর, সর্দি-কাশি বেশি হচ্ছে, এ জন্য চাহিদা বেড়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, জ্বর আসলে কোনো রোগ নয়। দেহে কোনো জীবাণুর সংক্রমণ হলে জ্বর হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির সংক্রমণে জ্বরে ভোগে মানুষ।
এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, দিন ও রাতের তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে এখন ভাইরাসজনিত জ্বর হচ্ছে। এই জ্বর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনে ছড়াচ্ছে। তাই তিন দিনের বেশি জ্বর থাকলে অবহেলা করা উচিত নয়। পরীক্ষা করানো উচিত। যেহেতু এখন আবার নতুন করে করোনা হাতছানি দিচ্ছে। এ ছাড়া ডেঙ্গু পুরোপুরি যায়নি। বিশেষ করে যেসব শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি ও ক্রনিক রোগের কোনো রোগী রয়েছে, তাদের এ বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, জ্বরের সঙ্গে ঘাড় বা শরীরে ব্যথা, উচ্চ তাপমাত্রা, বমি করা বা খাবার খেতে না পারা, তিন দিনের বেশি জ্বর থাকা, শুধু রাতে জ্বর আসা, শরীরে র্যাশ বের হওয়া, চোখ শুকিয়ে যাওয়া, খিঁচুনি হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।